Durga Puja 2020

আশ্বিনের হাওয়ায় ওড়ে বিসর্জনের কাগজ

ভাইয়ের মাথায় ঘোরে দুশ্চিন্তা। “দাদা, আমাকে কি দেশ থেকে তাড়িয়ে দেবে? আমি কোথায় যাব, দাদা?” ভাইয়ের পিঠে হাত রাখেন দাদা। “আয় অন্নদা, দুই ভাই গরম ভাতে নুন-লঙ্কা মেখে খাই।”

Advertisement

অনির্বাণ রায়

জলপাইগুড়ি শেষ আপডেট: ২৬ অক্টোবর ২০২০ ০২:০৪
Share:

অন্নদার বাবা-মা। ছবি: সন্দীপ পাল

বাইরে তখন ধানখেতে আছড়ে পড়ছে শেষ ভাদ্রের জোৎস্না। উঠোনে পায়ের শব্দ পেয়ে ঘরের বাইরে আসেন মধ্যবয়সী কৃষক। শরতের প্রথম জ্যোৎস্নার আলোয় তিনি দেখেন, উঠোনে দাঁড়ানো তাঁর ছোট ভাই। সংসার ভিন্ন হওয়ার পরে ভাই কোনও দিন আসেনি দাদার ঘরে। একই উঠোনে বেড়া দিয়ে ঘর আলাদা হয়েছে। স্ত্রী-দুই মেয়ে নিয়ে এক দিকের ঘরে থাকেন বড়ভাই, অন্য দিকে বাবা-মায়ের সঙ্গে ছোট ভাই। সংক্রান্তির রাতে বেড়া বাধা ডিঙিয়ে ছোটভাই এসে দাঁড়ায় বড়ভাইয়ের উঠোনে।

Advertisement

“দাদা, তুই নাম তুলেছিস?”

কিসের নাম! কোথায় তুলতে হবে! “ওই যে অসমে কত লোককে তাড়িয়ে দিচ্ছে। কম্পিউটারে নাম তুলতে হবে।” তোর নাম তো ভোটের কাগজে আছে, অভয় দেন দাদা। “তাতে নাকি হবে না, সবাই বলেছে। কম্পিউটারে নাম লিঙ্ক করতে হবে। আমি করতে গিয়েছিলাম, হয়নি। বাবা-মা সবার নাম আছে। আমার নেই।”

Advertisement

ঘরের ভিতর থেকে গরম ভাতের গন্ধ আসে। দাদার পেটে খিদে পাক দেয়। ভাইয়ের মাথায় ঘোরে দুশ্চিন্তা। “দাদা, আমাকে কি দেশ থেকে তাড়িয়ে দেবে? আমি কোথায় যাব, দাদা?”

ভাইয়ের পিঠে হাত রাখেন দাদা। “আয় অন্নদা, দুই ভাই গরম ভাতে নুন-লঙ্কা মেখে খাই।”

খাওয়ার কথা কানে ঢোকে না অন্নদার। অনির্দিষ্ট পায়ে সে ফিরে যায়। ভোরবেলা ঘুম ভাঙে মায়ের। ক’দিনের মতো কাল রাতেও ছোট ছেলেটা রাতে কিচ্ছুটি মুখে তোলেনি। আলুর তরকারিতে কলাই ছড়িয়ে দিলেই একথালা ভাত খেয়ে নিত যে ছেলে, সে এখন ভাতের থালা ঠেলে সরিয়ে দেয়। ঘরে উঁকি দেন মা। কিন্তু ছেলে তো বিছানায় নেই! হয়তো মাছ ধরতে গিয়েছে। গ্রামের ছেলেরা এ সময়ে ভোরে মাছ ধরতে যায়। ভাদ্র মাসে খেতে বিশেষ কাজ থাকে না।

ভোরের রোদ চড়া হয়, রাতের শিশির শুকিয়ে আসে। নদী থেকে বড় ছেলে ফেরেন। হাতে জাল। মা জিজ্ঞেস করেন, “কী রে! তোর ভাই ফিরল না?” চমকে ওঠেন বড়ভাই। অন্নদা তো নদীতে যায়নি। তা হলে? যে হাওয়ায় কাপাস তুলোর বীজ ওড়ে, সেই হাওয়ায় ভর করেই অন্নদার খবর এসেছিল সে দিন। হাওয়ার পিছনে ছুটে যান বড়ভাই। উঠোনে বসে পড়েন মা। পড়শিরা বাড়িতে ভিড় করে। বড় ছেলে ফিরে এসে বলেন, “মা, মাগো, তোর ছোট ছেলেটা নষ্ট হয়ে গেছে।”

বাড়ির দক্ষিণে ঘোষদের পুকুর পার হয়ে, ধানখেত ডিঙিয়ে, রেললাইন ছুঁয়ে, ওই যে রেলসেতু, সেখানেই গামছা গলায় বেঁধে ঝুলছে তখন ছোট ছেলের নিথর দেহ।

বছর ঘুরে গিয়েছে। সেই উঠোনের প্রান্তে বসে এখন মা বলেন, “ওই যে যাদের কাগজ নেই, অসম থেকে নাকি কাদের তাড়িয়ে দিচ্ছে। সে সব কথাই বলত ছেলেটা। আমাদের ভোটের কাগজ-টাগজ নিয়ে কয়েকটা অফিসে গিয়েছিল। সেখানে শুনেছে, আমাদের নাকি নাম আছে, কিন্তু ওর নাম নেই। তখন থেকেই মনমরা হয়ে থাকত।’’

খবরে প্রকাশিত হয়েছিল, নাম অন্নদা রায়। বাড়ি ময়নাগুড়ির ভোটপট্টির বড়কামাত গ্রামে। বয়স ৩৮। গত বছর ২০ সেপ্টেম্বর এনআরসি আতঙ্কে আত্মঘাতী হয়েছেন বলে প্রাথমিক তদন্তের পরে পুলিশ জানিয়েছে। তার পর থেকে গ্রামের পথে ধুলো উড়িয়ে গাড়ি-বাইক আসে বাড়িতে। মা বলে, “যে দিন ওর শ্রাদ্ধ হল, উনিশটা গাড়ি এসেছিল। আমার নাতনি (বড় ছেলে দক্ষদার মেয়ে) গুনেছে।” গাড়ি চেপে মন্ত্রী এসেছিলেন সে দিন, জানান দাদা দক্ষদা।

বছর ঘুরেছে। উঠোনে ছড়িয়ে আছে আর এক সেপ্টেম্বর শেষের রোদ। আশ্বিনের ছবি। মা বসে আছেন এক কোণে। বলছেন, ‘‘সাড়ে সাত বিঘে জমি ছিল আমাদের। দু’ছেলে আড়াই বিঘে করে চাষ করত। বাকি দু’বিঘে ওদের বাবার। আমি ছিলাম অন্নর সঙ্গে।’’ আনমনা মায়ের দৃষ্টি দরমার বেড়া পেরিয়ে গিয়েছে, ‘‘আমি পাটের আঁশ ছাড়াতাম, ছেলে হাল দিত। আমি চারা বুনতাম, ও মাটি কাটত।’’ আশ্বিন মাসগুলো ছিল অন্য রকম। মা বলেন, ‘‘স্কুটি কিনেছিল অন্ন। ছোট মেয়ে বাড়ি এল সে বার পুজোয়। তার এক মেয়ে। বড় ছেলের দুই। তিন জনকে স্কুটিতে বসিয়ে মেলায় গেল। খেলনা বন্দুক কিনল, বেলুন কিনল।’’ পুজোর ক’টা দিন টইটই করে বেড়াল খুব ক’দিন। মা বলছিলেন, ‘‘সামনের অঘ্রাণেই বিয়ে দেব ভেবেছিলাম। সামনের অঘ্রাণেই তো...।’’

মরা রোদ পড়েছে তাঁর মুখে। ফুরিয়ে যাওয়া অঘ্রাণ, আর হারিয়ে যাওয়া আশ্বিনে মাখামাখি হয়ে গিয়েছে তাঁর চোখ। একটু থেমে, মাথা নিচু করে, কব্জির উল্টো পিঠে তা মুছে নেন একবার। তার পরে প্রশ্ন করেন, “সত্যি কি ওকে দেশ থেকে তাড়িয়ে দিত?” শব্দহীন ঘরবাড়িতে ঘুরতে থাকে গোধূলির গন্ধ।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement