দার্জিলিং, কালিম্পং এবং ডুয়ার্সের ‘অফ বিট’ গন্তব্যে তিলধারণের জায়গা নেই। — নিজস্ব চিত্র।
পুজোর ছুটিতে সিকিম বেড়াতে যাবেন বলে যাঁরা বুকিং করেছিলেন, পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে তাঁরা পরিকল্পনায় বদল করছেন। সিকিমের পরিবর্তে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই তাঁদের ‘পরিবর্তিত’ গন্তব্য হচ্ছে দার্জিলিং, কালিম্পং এবং অবশ্যই ডুয়ার্স। পুজোর ভরা মরসুমে পর্যটক বোঝাই থাকবে উত্তর বাংলার প্রধান তিন পর্যটনক্ষেত্রই— সিকিমের অভূতপূর্ব বিপর্যয়ের প্রেক্ষিতে অন্তত এমনটাই আশা বাংলার পাহাড়ের পর্যটন সংস্থাগুলির।
পর্যটনের পাটিগণিত বলে, মূলত দুর্গাপুজো দিয়ে ভারতে উৎসবের মরসুমের শুরু। তার পর একে একে দীপাবলি, কালীপুজো, বড়দিন হয়ে বর্ষশেষ। ক্যালেন্ডার বলছে, পুজো আসতে আর বিশেষ দেরি নেই। পুরোদমে ছুটির সময় শুরু হল বলে। এই পরিস্থিতিতে শুধু বাংলাই নয়, দেশবিদেশের বহু মানুষেরই গন্তব্য থাকে হিমালয় দর্শন। কিন্তু অভূতপূর্ব প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের ঝাপটায় সিকিম এখন যাওয়ার অবস্থায় নেই। আগামী দু’মাসেও পড়শি রাজ্য আগের অবস্থায় ফিরতে পারবে কি না, তা নিয়ে সংশয় রয়েছে। অগত্যা, পর্যটকদের পরিকল্পনা সামান্য বদলে যেতে হচ্ছে দার্জিলিং, কালিম্পং এবং ডুয়ার্সে। কিন্তু দার্জিলিং, কালিম্পং বা ডুয়ার্সে বেড়াতে আসার জন্য অনেক আগে থেকেই বহু মানুষ বুকিং সেরে ফেলেছেন। ফলে, শেষ মুহূর্তে সিকিম যাত্রা বাতিল করে যাঁরা দার্জিলিং বা ডুয়ার্স যাওয়া মনস্থির করেছেন, তাঁরা কী করবেন? তাঁদের জন্য বরাভয় হয়ে উঠেছে এই এলাকার ‘রুরাল ডেস্টিনেশন’গুলি। অর্থাৎ, কোনও শহর বা গঞ্জ নয়, পাহাড়ের প্রত্যন্ত কোলে ছোট্ট কোনও জনপদ। সেখানকার অনামী ‘হোম স্টে’গুলি রাতারাতি ভরে উঠছে পর্যটকে, যাঁরা সিকিম যাবেন বলে ব্যাগ গুছিয়েছিলেন, প্রাকৃতিক বিপর্যয় তাঁদের পরিকল্পনা বদলাতে বাধ্য করেছে। সব মিলিয়ে, সিকিমের ভিড়কে জায়গা করে দিচ্ছে বাংলার প্রত্যন্ত পর্যটনক্ষেত্রগুলি।
যে সব পর্যটকের দুর্গাপুজো থেকে কালীপুজো পর্যন্ত উত্তর সিকিমে বুকিং রয়েছে, তাঁদের সঙ্গে কথা বলছে সংশ্লিষ্ট পর্যটন সংস্থাগুলি। সূত্রের খবর, পর্যটকদের একই বাজেটে বা তুলনামূলক ভাবে কিছুটা সস্তায় দার্জিলিং বা কালিম্পংয়ে ঘোরানোর কথা জানানো হয়েছে। বহু পর্যটকই তাতে রাজি হচ্ছেন, জানাচ্ছেন রাজ্যের ইকো ট্যুরিজ়ম দফতরের চেয়ারম্যান রাজ বসু। তবে পূর্ব এবং পশ্চিম সিকিমে যাওয়ার অনুমতি সিকিম সরকার দিলেও এখনই সেই সব বুকিং নিচ্ছে না পর্যটন সংস্থাগুলি। সূত্রের খবর, তিস্তার তাণ্ডবে লন্ডভন্ড অবস্থা উত্তর সিকিমের। সেই ধাক্কা কাটিয়ে আবার স্বমহিমায় ফিরতে সময় লাগবে। ফলে আপাতত উত্তর সিকিমে পর্যটনের সুযোগ প্রায় নেই বললেই চলে। এই পরিস্থিতিতে অনেকেই সিকিমের অন্যত্র বুকিং করিয়েও স্রেফ আশঙ্কার কারণে তা বাতিল করে দিচ্ছেন। ফলে তাঁদের পছন্দের তালিকায় চলে আসছে আপাত ভাবে নিরাপদ পাহাড়, জঙ্গল আর চা বাগানে ঢাকা ডুয়ার্স এলাকা। দার্জিলিং এবং কালিম্পংয়ের মতোই ডুয়ার্সেও রাতারাতি চাহিদা বেড়ে গিয়েছে পকেট রুটের ‘হোম স্টে’ তথা ‘রুরাল ডেস্টিনেশন’গুলির।
সিকিম নয়, পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে পর্যটকদের কাছে ‘হট কেক’ দার্জিলিং, কালিম্পং। — নিজস্ব চিত্র।
সিকিম যাবেন বলে তিন মাস আগে ট্রেনের টিকিট কেটেছেন। সমস্ত বুকিংও করা হয়ে গিয়েছে কসবার বাসিন্দা গৌরব বসুর। স্ত্রী, দুই সন্তান এবং বাবা-মাকে নিয়ে যাত্রা শুরুর কথা মহালয়ার আগের দিন। কিন্তু শুক্রবার বুকিং সংস্থা থেকে ফোন করে অনুরোধ করা হয়েছে গন্তব্য বদলের। গৌরব পরিবারের সঙ্গে কথা বলে স্থির করেছেন, পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে কালিম্পংয়ের প্রত্যন্ত এলাকায় একটি হোমস্টেতে যাবেন। গৌরবের স্ত্রী মহুয়া বলছেন, ‘‘বুকিং অফিস থেকে ফোন করে গন্তব্য বদলের অনুরোধ করেছিল। আমরা কথা বলে ঠিক করলাম, কালিম্পংয়ের হোম স্টেতে থাকব। সিকিমের যা অবস্থা, তাতে সেখানে বাচ্চা এবং বয়স্কদের নিয়ে যাওয়া সমস্যার। তাই এ বার হোমস্টেতেই পুজো কাটাব।’’ লেকটাউনের সৌমিত্র সান্যাল পরিবার নিয়ে সিকিম যাবেন বলে ঠিক করেছিলেন। টিকিট, হোটেল, গাড়ি বুকিংও হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু এ বার সিকিমের বদলে তাঁরা সপরিবার যাচ্ছেন ডুয়ার্স। সৌমিত্র বলেন, ‘‘সিকিমের যা অবস্থা, তাতে সেখানে না যাওয়াই স্থির করলাম। তার বদলে জলপাইগুড়ি আর আলিপুরদুয়ার যাচ্ছি। টিভিতে যা দেখলাম, তার পর আর পাহাড়ে যাওয়ার সাহস নেই। তাই চা বাগান আর জঙ্গলের মধ্যে হোম স্টেতে থাকব বলে ঠিক করেছি।’’ সূত্রের খবর, বুকিং সংস্থাগুলি পর্যটকদের সিকিমের তুলনায় কম খরচে ঘোরার পরিকল্পনা দিচ্ছেন। পছন্দ হলে সেখানেই কাটবে ছুটি। পাশাপাশি, বাড়তি টাকা হাতেগরম ফেরত দেওয়ার ব্যবস্থাও থাকছে। ডুয়ার্সে হোম স্টে চালাচ্ছেন জলপাইগুড়ির বাসিন্দা অঙ্কন দাস। তিনি বলছেন, ‘‘সিকিমের বিপর্যয়ের পর থেকে ফোন রাখতে পারছি না। যাঁদের সিকিমে বুকিং ছিল তাঁরা অনেকেই পাহাড় নিয়ে ভয়ে আছেন। তাঁরা ডুয়ার্সে আসতে চান। পাহাড় ছেড়ে এ বার পর্যটকদের একটা অংশ জঙ্গলমুখী হচ্ছেন বলে মনে হচ্ছে। এটা আমাদের জন্য ভাল সংবাদ। কারণ, এক বার যাঁরা ডুয়ার্সে আসবেন, আমি নিশ্চিত, প্রতি বার তাঁরা অন্তত এক বার সেখানেই ফিরে আসতে চাইবেন।’’
বাংলার পাহাড়ে পাইনের হাতছানি দেখতে ভিড় করছেন পর্যটকেরা। — নিজস্ব চিত্র।
রাজ বলেন, ‘‘দুর্গাপুজো থেকে কালীপুজো পর্যন্ত বুকিং তো শেষ। যাঁদের সিকিমে বুকিং ছিল, তাঁদের পরিস্থিতির কথা বুঝিয়ে পাহাড় বা ডুয়ার্সের দিকে পাঠানো হচ্ছে। আমাদের কাছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হল, যাঁরা এখনও সিকিমে আটকে রয়েছেন, তাঁদের সুস্থ ভাবে বাড়ি ফেরানো। সিকিম সরকার পূর্ব বা পশ্চিম সিকিমে পর্যটকদের অনুমতি দিলেও আমরা এখনও সেই বুকিং নিচ্ছি না৷ এর ফলে দার্জিলিং, কালিম্পং এবং ডুয়ার্সে পর্যটকদের সংখ্যা বাড়ছে।’’