জাপানি এনসেফ্যালাইটিসের উপসর্গ নিয়ে উত্তরবঙ্গ মেডিক্যালে ভর্তি শিশু।—নিজস্ব চিত্র।
জাপানি এনসেফ্যালাইটিস (জেই) বা অ্যাকিউট এনসেফ্যালাইটিস সিনড্রমে আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসা পরিষেবার জন্য আলাদা ওয়ার্ড খোলার নির্দেশ দিয়েছিলেন উত্তরবঙ্গ উন্নয়ন মন্ত্রী গৌতম দেব। সোমবারের মধ্যে ওই ইউনিট খোলার কথা ছিল। কিন্তু মঙ্গলবার দুপুর পর্যন্ত সেই ব্যবস্থা যথাযথ করে উঠতে পারেননি কর্তৃপক্ষ।
বৈঠকে ঠিক হয়েছিল, পুরুষ এবং মহিলাদের জন্য সেখানে যথাক্রমে ১০ টা এবং ৬ টা শয্যা থাকবে। গত শনিবার উত্তরবঙ্গ মেডিক্যালে পরিস্থিতি নিয়ে বৈঠক করে সে কথা জানিয়েছিলেন। অথচ সেই ব্যবস্থা করে এথনও রোগীদের সেখানে নেওয়া হয়নি। মেডিসিন বিভাগে জেই বা এইএস রোগীরা অন্যান্য রোগীদের সঙ্গেই রয়েছেন। হাসপাতালের ভারপ্রাপ্ত সুপার নির্মল বেরা বলেন, ‘‘মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে অন্যত্র ঘর থাকলেও মে়ডিসিন বিভাগের কাছেই ওই ওয়ার্ড খোলার ব্যবস্থা হচ্ছে। সে জন্যই ব্যবস্থা করতে একটু সময় লাগছে। তাতে মেডিসিন বিভাগের চিকিৎসকদের রোগীদের দেখভাল করতে সুবিধা হবে। যে রোগীরা এখন রয়েছেন তাদের স্থানান্তর করাতেও কিচু সমস্যা রয়েছে। তবে আলাদা ওয়ার্ডের ব্যবস্থা করে রাখা হচ্ছে।’’
হাসপাতালের একটি সূত্রই জানিয়েছে, মেডিসিন বিভাগের কাছে অর্থোপেডিক বিভাগের একাংশে ওই নতুন ওয়ার্ড চালুর ব্যবস্থা করা হয়েছে। তা নিয়েও রোগী স্বাস্থ্য কর্মীদের একাংশ প্রশ্ন তুলেছেন। তাঁদের দাবি, অর্থোপেডিক বিভাগের মধ্যে এই ওয়ার্ড না হলেই ভাল হয়।
রোগ রুখতে। ময়নাগুড়ির পেটকাটিতে
এ দিন ভোরে জেই আক্রান্ত এক মহিলার মৃত্যু হয়েছে। হাতপাতাল সূত্রে জানা গিয়েছে, তাঁর নাম গীতা দাস (৬১)। তিনি আলিপুরদুয়ারের কামাখ্যাগুড়ির বাসিন্দা। তাতে জুলাই মাসে ১৪ দিনে মৃতের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়াল ১১ জন। তার মধ্যে ৭ জনই জেই। বর্তমানে হাসপাতালে খিঁচুনি জ্বর নিয়ে আক্রান্ত অন্তত ১৮ জন রোগী রয়েছেন। তার মধ্যে চার জন জেই। বাকিরা অ্যাকিউট এনসেফ্যালাইটিস সিনড্রমে (এইএস) আক্রান্ত। তার মধ্যে ৪ জন রয়েছেন শিশু বিভাগে। দুই জনের অবস্থা সঙ্কটজনক হওয়ায় তাঁদের পেডিয়েট্রিক ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিটে (পিকু) রাখা হয়েছে। ৫ জন রয়েছেন সিসিইউ’তে।
উত্তরবঙ্গ মেডিক্যালে জেই বা এইএস আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসা পরিষেবা নিয়ে অভিযোগ রয়েইছে বাসিন্দাদের। খিঁচুনি জ্বর নিয়ে আক্রান্ত মাটিগাড়ার বাসিন্দা বৃদ্ধ লক্ষণ মণ্ডলের স্ত্রী ভাগ্যদেবী বলেন, ‘‘ঠিক মতো চিকিৎসা হচ্ছে। নার্সদের কিছু বলতে গেলে তাঁরা ধমক দিচ্ছেন। রোগী ঠিক মতো খাওয়াদাওয়া করছে না। তাই বাড়িতে নিয়ে যাব বলেই ভাবছি।’’ শিশু বিভাগে ভর্তি আলিপুরদুয়ারের দীপঙ্কর ওড়িয়ার মা দমন্তি ওড়িয়া জানান, কিছু ওষুধ হাসপাতাল থেকে পাচ্ছেন। তবে অনেক ওষুধই বাইরে থেকে কিনতে হচ্ছে। পরে সেই সব টাকা পাওয়া যাবে বলেও তাঁকে কেউ জানাননি। তাই তিনি দুশ্চিন্তায় রয়েছেন। তাছাড়া রক্ত পরীক্ষা করতে দুই তিন দিন সময় লাগছে বলেও জ্বর নিয়ে আক্রান্ত রোগীদের অনেকেই প্রশ্ন তুলেছেন।
এ দিন উত্তরবঙ্গ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে পরিস্থিতি খোঁজ করতে যান শিলিগুড়ির মেয়র অশোক ভট্টাচার্য। অধ্যক্ষ এবং ভারপ্রাপ্ত সুপারের সঙ্গে তিনি কথা বলেন। পুরসভার তরফে তারা কী করতে পারেন সে বিষয়ে পরামর্শ চান। আজ, বুধবার বেলা ১১ টায় পুরসভার তরফে পরিস্থিতি নিয়ে বৈঠকও ডাকা হচ্ছে। উত্তরবঙ্গ মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ মেয়রকে জানান সচেতনতা প্রচার এবং পুর এলাকায় শুয়োর পালন বন্ধ করার বিষয়টি জোর দিতে। মেয়র বলেন, ‘‘একজনও যদি মারা যায় তা হলেই পরিস্থিতি উদ্বেগজনক মনে করা যেতে পারে। তবে পরিস্থিতি এখনও নিয়ন্ত্রণের বাইরে যায়নি বলেই মনে হচ্ছে।’’ তাঁর কথায়, ‘‘শহরে দুয়েক জনের রোগ সংক্রমণ ধরা পড়লেও এখনও ব্যাপক হারে হয়নি। তবে ‘হবে না’ এ কথা কেউ বলতে পারেন না। তাই ডেঙ্গি, এনসেফ্যালাইটিস বা ম্যালেরিয়া প্রতিরোধে রক্তের নমুনা সংগ্রহের ব্যবস্থা পুরসভার তরফে করা যেতে পারে কি না বিষয়টি ভাবা হচ্ছে।’’ শহরে শুয়োরের খামার চিহ্নিত করে সেগুলির ব্যাপারে ব্যবস্থা নিতে কী করা যায় তা বুধবারের বৈঠকে আলোচনা হবে বলেও জানান তিনি। মেডিক্যাল কলেজ, কর্তৃপক্ষ জানিয়েছেন, জ্বর হলেই এনসেফ্যালাইটিস আক্রান্ত বা রক্ত পরীক্ষা করাতে হবে এমন হলে বহু কিট দরকার। সেই সব করতে গিয়ে কিট শেষ হলে বিপত্তি হতে পারে। তাই চিকিসক পরামর্শ দিলে তবেই রক্ত পরীক্ষা হতে পারে।
অন্যদিকে, জলপাইগুড়িতে এনসেফ্যালাইটিস রুখতে স্বাস্থ্য দফতরের সঙ্গে পুরসভা এবং প্রশাসন একযোগে কাজ করবে বলে সিদ্ধান্ত হয়েছে। মঙ্গলবার জেলাশাসকের কনফারেন্স হলে আয়োজিত এক সভার পরে জেলার মুখ্য স্বাস্থ্যআধিকারিক প্রকাশ মৃধা বলেন, “স্বাস্থ্য দফতর এবং পুরসভা জেলা প্রশাসনের সহযোগিতায় এখন থেকে একযোগে কাজ করবে।” জলপাইগুড়ি সদর হাসপাতালে ইতিমধ্যে সন্দেহজনক জ্বরে আক্রান্ত পুরুষ এবং মহিলা রোগীদের জন্য পৃথক দুটি ওয়ার্ড গঠন করা হয়েছে। যেসমস্ত বাড়িতে শুয়োর পালন করা হচ্ছে, সেখান থেকে শুয়োর বার করে নিয়ে আসা হবে। মহকুমা প্রশাসনের সহযোগীতায় পুরসভা এই কাজ করবে। শহরের বিশেষ কিছু জায়গায় সচেতনতার প্রচারে বোর্ড লাগানো হবে। পুরসভার পক্ষ থেকে ফগিং মেশিন ব্যবহার করে মশা তাড়ানোর ব্যবস্থা করা হবে। শহরের বস্তি এলাকায় যাদের মশারি নেই তাদের মশারি দেওয়ার ব্যবস্থা করবে পুরসভা।
জলপাইগুড়ি পুরসভার চেয়ারম্যান মোহন বসু বলেন, “গত দুবছরের তুলনায় এ বছর রোগের প্রকোপ কম। তা সত্বেও কোনও ঝুঁকি না নিয়ে আমরা একযোগে এই রোগের প্রাদুর্ভাব রোখার জন্য পরিকল্পনা নিয়েছি।”