যৌনপল্লিতে স্কুল চান দেবিকা

সকাল হতেই দৌড়ঝাঁপ শুরু হয়ে যায়। কে কে নিয়মিত স্কুলে যাচ্ছে না, তার খোঁজ নিতে বেরিয়ে পড়েন। আবার সন্ধেয় কারা নিয়মিত বই খুলে পড়তে বসছে না, সে দিকেও তাঁর সতর্ক নজর। এলাকার প্রবীণদের মধ্যে কারা কারা স্বাক্ষর পর্যন্ত করতে পারেন না, সে তালিকাও তাঁর তৈরি।

Advertisement

অরিন্দম সাহা

কোচবিহার শেষ আপডেট: ১৯ মার্চ ২০১৫ ০৩:১৩
Share:

স্কুলের জমির সামনে দেবিকা।

সকাল হতেই দৌড়ঝাঁপ শুরু হয়ে যায়। কে কে নিয়মিত স্কুলে যাচ্ছে না, তার খোঁজ নিতে বেরিয়ে পড়েন। আবার সন্ধেয় কারা নিয়মিত বই খুলে পড়তে বসছে না, সে দিকেও তাঁর সতর্ক নজর। এলাকার প্রবীণদের মধ্যে কারা কারা স্বাক্ষর পর্যন্ত করতে পারেন না, সে তালিকাও তাঁর তৈরি।

Advertisement

স্বেচ্ছাসেবী সংস্থায় কাজের সূত্রে কোচবিহারের যৌনপল্লি এলাকায় ওঁকে সবাই এক ডাকে চেনেন। সেই তরুণী দেবিকা রায় এ বার সেখানে আস্ত একটা স্কুল তৈরির কাজে পদক্ষেপ শুরু করেছেন। ইতি মধ্যে স্কুলের জন্য জমি চিহ্নিত করা হয়ে গিয়েছে। সম্ভাব্য শিক্ষক-শিক্ষিকাদের বাছাই করা হয়েছে। স্কুলের নামও ঠিক করে ফেলেছেন দেবিকা‘চেতনা’। জনপ্রতিনিধি থেকে প্রশাসন এগিয়ে এলে ভাল, না হলে ত্রিপল খাটিয়ে বাঁশের ঘর তৈরি করে আগামী এপ্রিলেই পঠন-পাঠন শুরুর পরিকল্পনা পাকা হয়ে গিয়েছে তাঁর। আপাতত দেবিকার ওই স্কুলের হাত ধরেই চেতনার আলো ছড়িয়ে পড়ার আশায় রয়েছে যৌনপল্লি। এলাকায় প্রিয়গঞ্জ কলোনি নামে যার পরিচিতি।

কোচবিহার দুর্বার মহিলা সমন্বয় কমিটি সূত্রে জানা গিয়েছে, কোচবিহার পুরসভা এলাকার ৬ নম্বর ওয়ার্ডে প্রিয়গঞ্জ কলোনি গড়ে উঠেছে। যেখানকার ছোট-বড় বাড়ি কিংবা কুঠুরিতে চার শতাধিক যৌনকর্মীর বসবাস। এলাকায় ৫-১৫ বছর বয়সী ছেলে-মেয়েদের সংখ্যা ৩৯ জন। তাদের কোনও না কোনও স্কুলের খাতায় নাম রয়েছে, কিন্তু বেশির ভাগই নিয়মিত স্কুলে যায় না।

Advertisement

সন্ধের আলো-আঁধারিতে এলাকার পরিবেশ অন্য রকম হয়ে ওঠে। ‘বাবু’দের ভিড়ে ঘরে ঠাঁই হয় না ছোটদের। এ দিক সে দিক ঘোরাঘুরি করে সময় কাটাতে হয়। গভীর রাতে ডাক পড়ে ঘরে ফেরার। ফলে পড়াশোনা প্রায় শিকেয় ওঠার জোগাড় তাদের। স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার কাজের সূত্রে যা নাড়া দেয় দেবিকাকে। তার পর থেকেই উদ্যোগ শুরু সান্ধ্য স্কুল চালুর।

দুর্বারের সদস্যরা পাশে দাঁড়ানোয় যে উদ্যোগ অনেকটা এগিয়েছে। কয়েক হাজার টাকা খরচ করে হবু পড়ুয়াদের জন্য ইতি মধ্যে খাতাকলম কিনেছেন। ব্ল্যাকবোর্ড আনার সিদ্ধান্ত হয়েছে। যৌনপল্লির এক কোণে পরিত্যক্ত জমি ক্লাসঘর তৈরির জন্য চিহ্নিত করা হয়েছে। কিছু দিনের মধ্যেই সেখানে পাকা না হলেও কাঁচা ঘর তৈরি শুরু হবে বলে জানান দেবিকা।

দুর্বার মহিলা সমন্বয় কমিটির কোচবিহারের সম্পাদিকা ছবি দাস বলেন, “সব রকম বিপদে-আপদে দেবিকা আমাদের পাশে রয়েছে। তাই ওর স্কুল তৈরির উদ্যোগের কথা জানতেই আমরাও ওকে সব রকম সাহায্য করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। তা ছাড়া আমি নিজেও সই করতে পারি না। স্কুল হলে নিজেও পড়ব বলে জানিয়ে দিয়েছি। এতে অন্তত সই করতে না পারার আক্ষেপটা তো ঘোচাতে পারব।” কমিটির সভাপতি পারুল দাস বলেন, “দ্রুত স্কুল চালুর অপেক্ষায় মুখিয়ে আছি।”

কিন্তু আচমকা এমন ‘ভূত’ কেন মাথায় চাপল দূর শিক্ষার ল্যাবরেটরি টেকনিশিয়ান কোর্সের ছাত্রী দেবিকার? দুর্বার কর্তৃপক্ষ জানাচ্ছেন, “যৌনপল্লি এলাকায় ছোটদের সমস্যা বিষয়ে আগে থেকেই তাঁর খানিকটা ধারণা ছিল। গত বছর উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করার পর স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা ‘শিস’ (সাদার্ন হেলথ ইমপ্রুভমেন্ট সোসাইটি)-এর সঙ্গে তিনি যুক্ত হন। তার পর থেকে এলাকার ঘরে ঘরে নানা কাজের প্রয়োজনে দেবিকার যাতায়াত বেড়ে যায়। চোখের সামনে ছোটদের অন্ধকার ভবিষ্যতের দিকে ঝুঁকে পড়া রুখতে কিছু একটা করার ভাবনা থেকেই স্কুলের উদ্যোগ দেবিকার। তার কথায়, “আমি-সহ তিন জন প্রতি দিন সন্ধেয় ক্লাস নেব। রবিবার হবে আঁকার স্কুল। সবার সাহায্য নিয়েই চেতনার যাত্রা শুরু করতে চাইছি।”

জনপ্রতিনিধি থেকে প্রশাসনের কর্তারা দেবিকার ওই উদ্যোগে খুশি। রাজ্যের পূর্ত পরিষদীয় সচিব রবীন্দ্রনাথ ঘোষ আন্তজার্তিক নারী দিবসের একটি অনুষ্ঠানে যোগ দিতে ৮ মার্চ ওই এলাকায় যান। সেখানেই ওই উদ্যোগের কথা জেনেছেন তিনি রবীন্দ্রনাথবাবু বলেন, “ভাল উদ্যোগ। ওই এলাকার শিক্ষা প্রসারে সমস্ত রকম সহযোগিতা করার কথা ইতিমধ্যে জানিয়ে দিয়েছি। কোচবিহারের সদর মহকুমা শাসক বিকাশ সাহা বলেন, “দেবিকারা আবেদন জানালে প্রশাসনিক ভাবে ওই স্কুলের ব্যাপারে কী সাহায্য করা যায় তা দেখা হবে।”

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement