ঘরের সামনে বাবুরামের স্ত্রী সঙ্গীতা। নিজস্ব চিত্র।
পিচ উঠে পাথর বেরিয়ে পড়েছে রাস্তার অনেকটা অংশে। ৩-৪ কিলোমিটার এমন রাস্তার পর আঁকাবাঁকা মাটি আর পাথরের পথ। পাশের জমিতে দেখা যাচ্ছে, আলু, ভুট্টা লাগাতে ব্যস্ত চাষিরা। বাতাসি থেকে প্রায় ৫ কিলোমিটার দূরে পশ্চিম ভদরা, শ্যানধনজোত, গোড়সাজোত এলাকা পেরিয়ে রানিগঞ্জ পানিশালি গ্রাম পঞ্চায়েতের অন্তর্ভুক্ত চুনিলাল গ্রাম। পাকা রাস্তার দু'ধারে টিনের, খড়ের, মাটির বাড়ি। তার পিছনে চাষের জমি। নেপাল সীমান্ত ঘেঁষা এই গ্রামে বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মানুষের বাস। সবাই যখন কাজে ব্যস্ত, তখন বাড়ির কাছে চুনিলাল প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মাঠে বসে রোদ পোহাচ্ছিলেন বাবুরাম হেমব্রম। নদী, পুকুরে মাছ ধরতেন। হাঁপানিতে কাবু হয়ে এখন প্রায় ঘরবন্দি। জানতে চাইলাম, চিকিৎসা করছেন না?
বাবুরাম: খাবার জুটছে না! আর চিকিৎসা করাব কেমন করে?
প্রশ্ন: স্বাস্থ্যসাথীর কার্ড হয়েছে?
বাবুরাম: সেটা আবার কী? তবে এক বছর আগে পরিবারের একটা কার্ড হয়েছে।
বাড়িতে নিয়ে গিয়ে দেখালেন তাদের কাছে থাকা কেন্দ্রের রাষ্ট্রীয় স্বাস্থ্যবিমার (আয়ুষ্মান) কার্ড। সেই কার্ডে কোনও সুবিধা পাননি না বলেও জানান।
প্রশ্ন: সরকারি হাসপাতালে গিয়েছিলেন?
বাবুরাম: একবার সরকারি হাসপাতালে গিয়ে পরীক্ষা করিয়েছি। তেমন কিছু হয়নি বলে চিকিৎসকরা জানিয়েছেন। কিন্তু আমার বুকের সমস্যা, কাশি। এই রোগই আমাকে দুর্বল করে দিয়েছে।
বাড়ির একটা ভাঙা খড়ের ঘরে চা গাছের আগাছা দিয়ে ধান সেদ্ধ করে মাঠে শুকাতে দিচ্ছিলেন তাঁর স্ত্রী সঙ্গীতা মিশ্র। তিন ছেলে দুই মেয়েকে নিয়ে ৫ জনের সংসার।
প্রশ্ন: থাকার ঘরও তো একটাই?
সঙ্গীতা: ঘরের জন্য নেতাদের জানানো হয়। ‘হবে হবে’ বলে তো আর কিছুই হচ্ছে না।
প্রশ্ন: সংসার চলে কী ভাবে?
সঙ্গীতা: দু’বিঘা জমিতে পরিবারের সকলে মিলে ধান চাষ করেছি। রেশন থেকে চাল, আটা পেলেও এখন সে রকম পাই না (করোনার সময়ে কেন্দ্র থেকে যে বিনামূল্যে খাদ্যশস্য দেওয়া হত, তা এখন বন্ধ। রাজ্যের দেওয়া খাদ্যশস্য এখনও আছে, তবে তার পরিমাণ কমিয়ে চাল ও আটায় ভাগ করে দেওয়া হয়েছে, জানালেন স্থানীয় লোকেরা)। কোনও দিন চাল ভাজা, আধপেটা খেয়েই দিন কাটে।
প্রশ্ন: কৃষক বন্ধু প্রকল্পের সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন?
বাবুরাম: কী ভাবে হবে, জানি না।
প্রশ্ন: একশো দিনের কাজ পান?
বাবুরাম: অনেক দিন আগে পেয়েছি। নেতাদের জবকার্ড জমা দেওয়ার পর এক বছরের বেশি দিন থেকে কার্ডও নেই, কাজও নেই।
তাঁরা জানেন না ‘দুয়ারে সরকার’ কর্মসূচির কথাও।
বাবুরামের বাড়ির রাস্তার আর এক পাশে মহম্মদ অমরউদ্দিনের বাড়ি। প্রধানমন্ত্রী আবাস যোজনার ঘর পেয়েছেন। কিন্তু সেই ঘরের দেওয়াল পাকা হলেও চাল টিনের।
প্রশ্ন: প্রধানমন্ত্রী আবাস যোজনার ঘরের টিনের চাল কেন?
অমর: ৭০ হাজার টাকা তিন দফায় পেয়েছি। একটিই থাকার ঘর ছিল। নতুন ঘর তৈরি সময় খোলা আকাশে থাকতে হয়েছিল। শেষ কিস্তির টাকা না পেয়ে কষ্ট করে ঘরে এই চালটাই দিতে পেরেছি।
প্রশ্ন: বাকি টাকা কেন পেলেন না?
অমর: নেতাদের বললে বলে এখনও ঢোকেনি। দুই বছর হল। কবে ঢুকবে জানি না।
৮০ ছুঁই ছুঁই এই বৃদ্ধ ভাতা পান। কিন্তু লকডাউনের পর থেকে টাকা ঢুকছে না বলে জানান। সংসারে ছেলে, তাঁর স্ত্রী কাজ করে কোনও রকম সংসার চলান।
বাসিন্দাদের অভিযোগ, অনেকেই সরকারের অনেক প্রকল্প থেকে এক রকম বঞ্চিত। অনেক পরিবার ধান চাষের উপর নির্ভর। সহায়ক মূল্যে ধান বিক্রির কথা জানা না থাকায় স্থানীয় ফড়েদের কাছেই এত দিন ধান বেচতেন বলে দাবি তাঁদের। বেশিরভাগ বাড়িতে পানীয় জলের সমস্যা। কলের আয়রন যুক্ত জলের উপর নির্ভর করতে হয় অনেককে। উজ্জ্বলা যোজনার গ্যাস পাননি অনেকেই। স্থানীয় তৃণমূলের পঞ্চায়েত সদস্য সে সব বিষয়ে উদাসীন বলেই তাঁদের অভিযোগ।
(পরের ‘দর্পণ’ মঙ্গলবার)