হিলি সীমান্তের এই জায়গাতেই বিজিবি গুলি চালায় বলে অভিযোগ। —নিজস্ব চিত্র।
সীমান্তের জিরো পয়েন্ট টপকে ভারত ভূখন্ডে দাঁড়িয়ে স্থানীয় এক যুবককে গুলি করে দেহ ওপারে টেনে নিয়ে যাওয়ার অভিযোগ উঠল বাংলাদেশ বর্ডার গার্ডের (বিজিবি) বিরুদ্ধে। বিজিবির গুলিতে আর এক ভারতীয় বাসিন্দা জখম হন বলেও অভিযোগ। তাঁকে বালুরঘাট জেলা হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়েছে। মঙ্গলবার বিকেলে দক্ষিণ দিনাজপুরের হিলি সীমান্তের দক্ষিণপাড়া এলাকায় এই ঘটনা ঘটে। পুলিশ ও বিএসএফ সূত্রের খবর, বিজিবির অন্তত ৭-৮ জনের একটি দল এপারে ঢুকে এলোপাথাড়ি গুলি চালিয়েছে। নিহত যুবকের নাম বিটন বর্মন (৩১)। তিনি হিলির ওই দক্ষিণপাড়ার বাসিন্দা।
বিজিবি-র ওই দলটি অন্তত ৮ থেকে ১০ রাউন্ড গুলি চালিয়েছে বলে স্থানীয় বাসিন্দারা জানিয়েছেন। আচমকা পরপর গুলির শব্দ ও স্থানীয় যুবকের হতাহতের ঘটনার আকস্মিকতায় এলাকার বাসিন্দাদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। ঘটনাস্থল থেকে দূরে বিএসএফের দু’জন জওয়ান সীমান্ত পাহারায় ছিলেন। তাঁরা গুলির শব্দ পেয়ে ছুটে আসার আগেই ওই দলটি বিটনের দেহ টেনে নিয়ে যায় বলে অভিযোগ। পুলিশ সূত্রের খবর, এদিন ঘটনাস্থল থেকে কিছু টুপি, জ্যাকেট ও গুলির খোল পুলিশ উদ্ধার করেছে। সেগুলি বিজিবির কি না, তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে।
ঘটনার খবর পেয়ে বালুরঘাট থেকে পুলিশ সুপার সহ বিএসএফের পদস্থ আধিকারিকেরা ওই এলাকায় গেলে তুমুল উত্তেজনা দেখা দেয়। বিনা প্ররোচনায় বিজিবির বিরুদ্ধে গুলি চালানো ও নিহত যুবকের দেহ টেনে নিয়ে যাওয়ার অভিযোগে এলাকাবাসী সরব হন। বাসিন্দাদের একাংশের দাবি, বিজিবির কয়েকজন কর্মীর বিরুদ্ধে এলাকার মহিলাদের কটূক্তি করার অভিযোগ নিয়ে কয়েকদিন থেকে উত্তেজনা ছিল। এদিন এক মহিলা সীমান্ত লাগোয়া জমিতে গেলে কটূক্তি করা হয় বলে অভিযোগ। এলাকার কয়েকজন যুবক প্রতিবাদ করলে বিজিবি ঢিল ছোড়ে। যুবকেরাও পাল্টা ঢিল ছুড়তে থাকে। সে সময় আচমকা ওপার থেকে বিজিবি জওয়ানেরা গ্রামে ঢুকে যুবকদের লক্ষ্য করে গুলি চালায় বলে অভিযোগ।
তবে বিজিবি বিএসএফের কাছে সেই অভিযোগ অস্বীকার করেছে। তাঁরা দাবি করেছেন, তাঁদের এলাকায় ঢুকে পাচারের চেষ্টা হচ্ছিল। আপত্তি জানালে দলটি পাল্টা চ্যালেঞ্জ জানিয়ে ঢিল ছুড়তে থাকলে বিজিবির এক জওয়ান গুলি চলাতে বাধ্য হন। গুলিবিদ্ধ দেহ তাদের সীমানার দিকে টেনে নিয়ে যাওয়ার অভিযোগও বিজিবি অস্বীকার করেছে। কিন্তু এলাকাবাসীর অভিযোগ, বিজিবির গুলিতে বিটন লুটিয়ে পড়ার পর তাকে ওপারে টেনে নিয়ে গিয়ে খুব কাছ থেকে আরও চার-পাঁচ রাউন্ড গুলি চালানো হয়েছে।
দক্ষিণ দিনাজপুরের পুলিশ সুপার শীশরাম ঝাঝারিয়া বলেন, ‘‘বিএসএফের সঙ্গে বিজিবির ফ্ল্যাগ মিটিঙের মাধ্যমে ওই যুবকের দেহ এপারে আনার প্রস্তুতি চলছে। এই প্রক্রিয়া শেষ হতে রাত হবে। ফ্ল্যাগ মিটিঙের পরই জানা যাবে, কী কারণে বিজিবি গুলি চালিয়েছে।’’ হিলি বিএসএফের কমান্ড্যান্ট রাজেন সুদ বলেন, ‘‘প্রাথমিকভাবে সীমান্তে পাচার সংক্রান্ত কোনও বিষয়ের জেরে ওই ঘটনা ঘটেছে বলে সন্দেহ। তবে ভারত ভূখন্ডে ঢুকে বিজিবি গুলি চালিয়েছে বলে যে অভিযোগ উঠেছে, তার তদন্ত হবে। ফ্ল্যাগ মিটিঙে গুলি চালানোর অভিযোগের বিষয়টি জানতে চাইব।’’
বালুরঘাট হাসপাতালে ভর্তি গুলিতে জখম যুবক প্রশান্ত রায় অবশ্য দাবি করেন, ‘‘বিকেল সাড়ে ৪টা নাগাদ কয়েকজন মিলে ক্রিকেট খেলছিলাম। সে সময় ক্রিকেট বল সীমান্তের ওপারে চলে যায়।’’ ওই বল আনতে গেলে বিজিবি জওয়ানেরা বাধা দিলে বিটন তর্ক জুড়ে দেন বলে অভিযোগ। প্রশান্ত বলেন, ‘‘কথা কাটাকাটির সময় হঠাৎই বিজিবির এক জওয়ান স্বয়ংক্রিয় রাইফেল থেকে বিটনকে লক্ষ্য করে গুলি চালাতে থাকে। তাকে লুটিয়ে পড়তে দেখে সকলে পালাতে থাকি। সে সময় আমার হাতে গুলি লাগে। এরপর বিটনের নিথর দেহ বিজিবির জওয়ানেরা টেনে নিয়ে ওদের সীমানার মধ্যে চলে যায়।’’
অভিযোগের আঙুল উঠেছে বিএসএফের দিকেও। এলাকায় কাঁটাতারের বেড়া নেই। উন্মুক্ত দক্ষিণপাড়ার জিরো পয়েন্ট পেরিয়ে এপারে ঢুকে বিজিবির জওয়ানেরা কাছ থেকে ওই যুবককে লক্ষ্য করে পাঁচ রাউন্ড গুলি চালিয়ে অপর একজনকে জখম করে কী করে পালিয়ে গেল, তা নিয়ে বাসিন্দারা প্রশ্ন তুলেছেন। তাঁদের বক্তব্য, বিএসএফ নজরদারিতে ঢিলে দেয় বলেই এটা সম্ভব হতে পারে। স্থানীয় সূত্রের খবর, ওই এলাকার সীমান্তের ওপারে কর্তব্যরত বিজিবির কয়েকজন জওয়ানের টার্গেট হয়ে পড়েছিল বিটন। ঘটনা খতিয়ে দেখতে বিএসএফ এবং পুলিশ তদন্ত শুরু করেছে। বিটনের এক আত্মীয় সমীর বর্মনের অভিযোগ, ‘‘বিজিবির অন্যায় কাজের বিরুদ্ধে সরব ছিল বিটন। সে কারণে ও তাদের লক্ষ্য হয়ে পড়েছিল। কার্যত বিনা প্ররোচনায় এপারে ঢুকে নিরস্ত্রদের উপর বিজিবি গুলি চালিয়েছে।’’
বিজিবির গুলিতে প্রশান্তের বাঁ হাতে ফুঁড়ে বেরিয়ে গিয়েছে। গুরুতর জখম অবস্থায় প্রশান্তকে প্রথমে হিলি গ্রামীণ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখান থেকে তাকে বালুরঘাট জেলা হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়েছে।