বাচ্চা কোলে ফিরেছে সেই শান্ত মেয়েটির

সকালে সুশান্তের মা সুশীলাদেবী নাতিকে দেখেই হাসপাতালের মধ্যে অফিসারদের পা জড়িয়ে ধরেন। কোনও ক্রমে তা ছাড়ান বিড়ম্বিত অফিসারেরা। সকাল থেকে হাসপাতালে রাত অবধি কাটিয়েছে পরিবারটি। মা সোমাদেবী মাঝেমধ্যেই গিয়ে বারবার দেখে এসেছেন ছেলেকে।

Advertisement

কৌশিক চৌধুরী

শিলিগুড়ি শেষ আপডেট: ১৯ জানুয়ারি ২০১৮ ০২:৪৫
Share:

স্বস্তি: হারানো সন্তানকে কোলে পেয়ে অপার নিশ্চিন্দি সোমার মুখে-চোখে। ছবি: বিশ্বরূপ বসাক

কী ভাবে যে দিনরাত কেটেছে! বলছিলেন সুশান্ত সরকার। হারানো শিশুর বাবা।

Advertisement

চাপ কী কম গিয়েছে তাঁর! মঙ্গলবার দুপুরে হাসপাতাল থেকে হারিয়ে গিয়েছে ২৫ দিনের শিশু। বুধবার সারাদিন ধরে খুঁজে তার কোনও হদিসই করতে পারেনি পুলিশ। নাওয়া-খাওয়া ভুলে দিনভর থানা আর বাড়ি করে গিয়েছেন সুশান্ত। সন্ধ্যাবেলা আবার ছেলের শোকে বাড়ি থেকে বেড়িয়ে যান উদভ্রান্ত স্ত্রী। তাঁকেও খুঁজে আনতে হয়েছে। সে সব সেরে ফিরতে রাত দশটা বেজে গিয়েছে। তার পরে পুলিশ জানিয়েছে, চোরের সন্ধান মিলেছে। চলে আসুন। আবার পড়িমরি করে ছুটেছেন তাদের সঙ্গে ধূপগুড়ির দিকে।

‘‘কিন্তু সব ভাল যার শেষ ভাল,’’ বৃহস্পতিবার সকালে হাসতে হাসতে বলছিলেন সুশান্ত। বলছিলেন আর তাকিয়ে দেখছিলেন স্ত্রীর দিকে। এক দিন যেন কত রোগা হয়ে গিয়েছেন তিনি। কিন্তু কোলে ছেলেকে নিয়ে মুখ তাঁর ভরে গিয়েছে হাসিতে। সে দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে হালকা হাতের ছোঁয়ায় চোখের কোণটা মুছে নিলেন। ঝাপসা হয়ে এল কি? ঝলমলে হাসিতে মুখ ঘুরিয়ে বললেন, ‘‘ওই যে পুলিশদাদারা, তারাই আজ ছেলের আসল আত্মীয়।’’

Advertisement

সুশান্তের কথায়, ‘‘আইসি দেবাশিস বসু, তদন্তকারী অফিসার সজল রায়, দাওয়া শেরপা ও জেভি লেপচা-র কাছে আমরা চির কর্তৃজ্ঞ হয়ে রইলাম।’’ কাছেই বসেছিল সেই ছোট্ট মেয়েটা, যার হাত থেকে হারিয়ে যায় শিশু। দু’দিনের উৎকণ্ঠা শেষ, চোখমুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছিল। সে বলল, ‘‘বাচ্চা যে ফিরে এসেছে, সেটাই একমাত্র শান্তি।’’

রুদ্ধশ্বাস ৩৬ ঘণ্টা

বুধবার


দুপুর দেড়টা: কাছারি রোড থেকে কিশোরী পিসিকে ভুলিয়ে শিশু চুরি।


বিকাল ৪টা: শিলিগুড়ি থানায় অভিযোগ। সিসিটিভিতে চুরির ছবি। গোটা মহকুমায় তল্লাশি।

বৃহস্পতিবার


দুপুর ১২টা: হাসপাতাল সুপারকে বিক্ষোভ বিভিন্ন সংগঠনের।


রাত ৯টা: ইস্টার্ন বাইপাসের পূর্ব মাঝাবাড়ি ও হাতিয়াডাঙাতে মহিলা-সহ সদ্যোজাতের খোঁজ।


রাত ১১টা: অভিযুক্তদের মোবাইলের সূত্রে ধূপগুড়িতে পুলিশ টিম। সঙ্গে শিশুর বাবা।


রাত ৩টে: ধূপগুড়ির ঠাকুরপাট থেকে অভিযুক্ত সবিতা,
তাঁর বাবা সুকুমার গ্রেফতার। শিশু উদ্ধার।

শুক্রবার


সকাল ৭টা: হাসপাতালে মা-র কোলে ফিরল শিশু। ধৃতরা থানায়।

শিশুকে যে পাওয়া গিয়েছে, সকালেই সে খবর এসে পৌঁছয় ৪ নম্বর ওয়ার্ডের জ্যোতিনগরে। বহু বাসিন্দা তখনই ছোটেন হাসপাতালে। কারও কোলে ছোট ছেলেমেয়ে। কারও হাতে বাজারের ব্যাগ। কমলা সরকার, স্বাতী বর্মন, কুন্দন শর্মারা জানান, শুধু কি সরকার পরিবার। গোটা পাড়া, কলোনি ঠিকমতো খায়নি, ঘুমোয়নি। অবশেষে শান্তি মিলল।

সকালে সুশান্তের মা সুশীলাদেবী নাতিকে দেখেই হাসপাতালের মধ্যে অফিসারদের পা জড়িয়ে ধরেন। কোনও ক্রমে তা ছাড়ান বিড়ম্বিত অফিসারেরা। সকাল থেকে হাসপাতালে রাত অবধি কাটিয়েছে পরিবারটি। মা সোমাদেবী মাঝেমধ্যেই গিয়ে বারবার দেখে এসেছেন ছেলেকে। বিকেল অবধি তাই মহানন্দা নদীর পারের টিনের জীর্ণ বাড়িটি পাহারা দিয়েছে সুশান্তের আর এক বোন লক্ষ্মী ও আত্মীয়েরা। সে বলে, ‘‘ভাইপো বাড়িতে নেই, ভাবতেই পারছিলাম না।’’

বিকাল থেকে কালী-শিব মন্দির লাগোয়া বাড়িটি ঘিরে লোকজনের ভিড় বাড়ে। কাজকর্ম সেরে অলিগলি থেকে মহিলারা বার হয়ে আসেন। সকলের মুখেই একটাই প্রশ্ন, ‘‘পাড়ার একরত্তি ছেলেটা কখন আসবে? শুনলাম, আদালত অনুমতি দিলে নাকি আসবে!’’ সন্ধ্যায় সকলে জানতে পারেন, আদালত দিলেও হাসপাতালে চিকিৎসক, নার্সরা বলেছেন, ছেলেটি একদিন হাসপাতালে থাকুক। ঠান্ডায় কোলে কোলে ঘুরেছে। একটু খাওয়া-দাওয়া করে চা‌ঙ্গা করে বাড়ি যাবে।

এখন শুধু তার ঘরে ফেরার অপেক্ষা জ্যোতিনগরে।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement