‘‘কংগ্রেস তখন ক্ষমতায়। আলাদা রাজ্য নিয়ে আমাদের দাবি পেশ করতে দিল্লি গিয়েছিলাম,’’ বলছিলেন অনন্ত রায়, মহারাজ হিসেবে যিনি এই এলাকায় সমধিক পরিচিত।
অন্ধকার নেমেছে। আমরা বসে আছি ‘মহারাজের’ প্রাসাদের চৌহদ্দির মধ্যে। তিনি বসে রয়েছেন বাড়ির সামনে হাতায় লম্বা ছাউনিটির নীচে। সামনে দীর্ঘ টেবিল। আমরা বসে টেবিলের উল্টো দিকে। তাঁর হাতে দু’টি ক্যাপসুল। বারবার সে দু’টিকে সামনে ঠেলে সাবধানে গুছিয়ে রাখছেন। থেমে থেমে কথা বলেন তিনি। তার মধ্যেই একে একে বলে চলেছেন বিভিন্ন বিষয় নিয়ে।
অনন্ত বলছিলেন, কোচবিহারের ভারতভুক্তি চুক্তি নিয়ে তিনি দরবার করেছিলেন কংগ্রেস আমলে। দিল্লি গিয়ে। জানালেন, সেই সময়ে রাজ্যে বাম আমল। দিল্লিতে তিনি যুক্তি দিয়ে বুঝিয়েছিলেন, কেন কোচবিহারকে আলাদা রাজ্য করতে হবে। কিন্তু যে মুহূর্তে সে প্রস্তাব তারা কলকাতায় বিবেচনার জন্য পাঠায়, আটকে যায় যাবতীয় আলোচনা।
এই যে তাঁকে ব্যতিব্যস্ত হতে হল, সফল হতে পারলেন না, সে জন্য কি তিনি ক্ষুব্ধ? মহারাজের কথায় স্পষ্ট বোঝা যায় না। তিনি মাঝে মাঝে হেসে ওঠেন। কথার মাঝে ছোট-বড় বিরতি দেন। ঠিক যেমন হয় নাট্যমঞ্চে। শুধু কংগ্রেস আমলই নয়, তিনি বংশীবদন বা স্থানীয় তৃণমূল নেতৃত্বকে নিয়ে বলার সময়ও নিজেকে একই রকম নির্লিপ্ত রাখতে পারেন।
তবে অনন্ত বিশ্বাস করেন, স্থানীয় তৃণমূল নেতৃত্বের প্রভাব কাটিয়ে মুখ্যমন্ত্রী তাঁর গুরুত্ব বুঝতে পেরেছেন। কী ভাবে? তিনি বলেন, ‘‘উনি তো এসেছেন এখানে অনুষ্ঠানে যোগ দিতে। আমাদের ডাকে সাড়া দিয়ে যে তিনি এখানে এসেছেন, তাতে আমরা খুশি।’’ জানান, তাঁর নাতির জন্মদিনে উপহার পর্যন্ত পাঠিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী। চিলা রায়ের জন্মজয়ন্তীতে এসে মুখ্যমন্ত্রী বলেছিলেন, অনন্তের তৈরি নারায়ণী সেনাকে পুলিশের কাজে নেওয়া যায় কিনা, খতিয়ে দেখতে চান। জিজ্ঞাসা করেছিলেন, অনন্তের আপত্তি আছে কি না। আমাদের সামনে বসে অনন্ত জানান, তাঁর কোনও আপত্তি নেই। তিনি বলেন, ‘‘আমার কেন আপত্তি হবে? যদি ওরা পুলিশে চাকরি পায়, কাজ পাবে। ওদের ভাল হবে।’’ তবে তাঁর উপরে যে পুলিশি অত্যাচার এক সময়ে হয়েছে, তাঁকে যে পালিয়ে থাকতে হয়েছে, সেটা অনেকে এখনও ভোলেনি— দাবি করলেন অনন্ত। সেই ক্ষোভ রয়েছে স্থানীয়দের মধ্যে, জানান তিনি।
তা হলে কি এই ভাবে নিজের প্রভাবের কথাই মনে করিয়ে দিলেন? অনন্ত কিছু বলেন না, শুধু হাসেন। জানিয়ে দেন, কোচবিহারের উন্নয়ন যাঁরা চান, তাঁদের তিনি সহযোগিতা করবেন। তাঁর কোনও দল নেই। এ কথা অবশ্য তিনি সম্প্রতি অমিত শাহের সঙ্গে দেখা করার সময়ও বলেছেন।
নিজের সম্পর্কে বলতে গিয়ে বারবার তাঁর মুখে এসেছে অত্যাচারিত হওয়ার কথা। সপ্তম-অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত লেখাপড়া করা মানুষটিকে হঠাৎই এক দিন মহারাজ করে মাথায় মুকুট পরিয়ে দেওয়া হয়। সেই কথা বলতে বলতেই এসে পড়ে তাঁর অসমে পালিয়ে যাওয়ার কথা। গত লোকসভা ভোটের আগেও তিনি রাজ্য এসে পুরোপুরি থিতু হতে পারেননি। কাওয়াখালির মাঠে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সভাতেও দীর্ঘক্ষণ তাঁকে দূরে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়েছিল। পরে তাঁকে মঞ্চে তুললেও মোদী কি সে দিন দূরত্ব রেখেই চলেছিলেন?
তবু বিজেপির দিকেই তাকিয়ে আছেন অনন্ত, তাঁর দাবির কোচবিহার লাভের আশায়। (চলবে)