লাল-তেরঙ্গা এক কাঁধে, সিগারেট পুড়ছে অনন্তের

চোখে তখনও ঘুমের রেশ। গলাও কিছুটা ধরা। ফিনফিনে পাঞ্জাবি এবং ছাপানো লুঙ্গি পরে বাছাই করা কর্মী সমর্থকদের সঙ্গে আলোচনা সেরে নিচ্ছেন। সিগারেট বের করে ফাঁকা প্যাকেটটি কিছুটা দূরের বাস্কেটে ছুঁড়ে দিতেই, রে রে করে উঠলেন কর্মীরা, ‘‘দাদা একটা হল।’’

Advertisement

অনির্বাণ রায়

ময়নাগুড়ি শেষ আপডেট: ১০ এপ্রিল ২০১৬ ০২:১৩
Share:

চোখে তখনও ঘুমের রেশ। গলাও কিছুটা ধরা। ফিনফিনে পাঞ্জাবি এবং ছাপানো লুঙ্গি পরে বাছাই করা কর্মী সমর্থকদের সঙ্গে আলোচনা সেরে নিচ্ছেন। সিগারেট বের করে ফাঁকা প্যাকেটটি কিছুটা দূরের বাস্কেটে ছুঁড়ে দিতেই, রে রে করে উঠলেন কর্মীরা, ‘‘দাদা একটা হল।’’

Advertisement

পাঞ্জাবির পকেটে হাত গলিয়ে টেবিলে রাখলেন সিগারেটের আরও একটি নতুন প্যাকেট। একমাসও পেরোয়নি গলায় সংক্রমণ ধরা পড়েছে। ঠান্ডা পানীয় আর সিগারেটে কড়া বারণ চিকিৎসকের। প্রথম কয়েকদিন শুনেওছিলেন। কিন্তু ভোট যত এগিয়ে আসছে ময়নাগুড়ির আনন্দনগরে অনন্তদেব অধিকারীর বাড়ির আবর্জনা ফেলার ঝুড়িতে ফাঁকা সিগেরেটের প্যাকেটের সংখ্যা ততই বেড়ে চলেছে। অনন্তবাবু নিজেই জানালেন, ‘‘এখন একটু বাড়বেই। ভোটের পরে কমিয়ে দেব।’’

পুরসভা ঘোষণার সিদ্ধান্তে মন্ত্রিসভার অনুমোদন ও পুরসভা নিয়ে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের পর দু’বার ময়নাগুড়িতে আবির খেলা হয়েছে। ময়নাগুড়িকে পুরসভা ঘোষণার কৃতিত্ব যে তৃণমূলের ঝুলিতেই যাবে তা নিয়ে বাম-কংগ্রেস নেতা-কর্মীদেরও কোনও সংশয় নেই। ভেটেনারি কলেজের শিলান্যাসও হয়েছে ময়নাগুড়িতে, কলেজে কয়েকশো কর্মসংস্থান হবে বলেও প্রচার চালাচ্ছে তৃণমূল। গ্রাম-শহরের কোন কোন পরিবার দু’টাকা কেজি চাল পেয়েছেন, কোন পরিবার ‘সবুজ সাথী’র সাইকেল পেয়েছেন তাও তালিকাভুক্ত হয়েছে। কর্মী সমর্থকরা দাবি করছেন, বিধানসভা এলাকার প্রায় সব বাড়িতেই একাধিক সরকারি প্রকল্পের সুবিধে ঢুকেছে, সেটাই সাফল্য। পুরসভার আবেগ-সরকারি প্রকল্পের সাফল্যের ঢালাও ফিরিস্তি প্রচারে থাকলেও, স্বস্তিতে নেই অনন্তদেববাবু। দলের প্রচার কমিটি কর্মসূচি তৈরি করে দিলেও, অনন্তদেববাবু তাতে নিশ্চিন্ত হতে পারছেন না। নিজেই কয়েকজন অনুগামীকে নিয়ে সকাল থেকে বেরিয়ে পড়ছেন। ঠিক করেছেন বিধানসভার সব বাড়ি-বাড়ি যাবেন। বছর দেড়েক আগে উপনির্বাচনে প্রায় তিরিশ হাজারের বেশি ভোটে জিতেছিলেন অনন্তদেববাবু।

Advertisement

দু’হাজার এগারোয় আরএসপির টিকিটে জেতা অনন্তদেববাবু রাজ্যসভার ভোটের আগে তৃণমূলে যোগ দেন। ২০১৪ সালে লোকসভা ভোটের সময় উপনির্বাচনে তৃণমূলের হয়ে বিপুল মার্জিনে জেতেন। পুরস্কার হিসেবে ময়নাগুড়িকে পুরসভা ঘোষণা করে রাজ্য সরকার, একাধিক প্রকল্পের শিলান্যাস হয়। সবই চিত্রনাট্য মেনেই চলছিল।

সেই নিখুঁত চিত্রনাট্যে ছন্দপতন ঘটেছে ভোটের আগেই। আরএসপি ছেড়ে ‘সুদিনে’ দলে আসা অনন্তবাবুকে এবারে প্রার্থী না করার দাবিতে ময়নাগুড়ির রাস্তায় মিছিল করেন তৃণমূলেরই কর্মী-সমর্থকরা। দলের পতাকা-ফেস্টুন নিয়ে সে মিছিল শহরে ঘোরে। ক্ষুব্ধ অনন্তবাবু এবং তাঁর অনুগামীরা মিছিলে যাঁরা হেঁটেছিলেন তাঁদের বিরুদ্ধে দলের পদক্ষেপের দাবি জানান। অনন্তবাবুকে দল টিকিট দিলেও, বিক্ষুব্ধদের বিরুদ্ধে কোনও ব্যবস্থাই নেয়নি। বিক্ষুব্ধদের কয়েকজনকেই অনন্তবাবুর ভোটের কাজের দায়িত্ব দিয়েছে দল। অস্বস্তি তাতেই বেড়েছে। বিদায়ী বিধায়কের সঙ্গীদের আশঙ্কা, ক’দিন আগে যাঁরা অনন্তবাবুর বিরুদ্ধে স্লোগান তুলেছিলেন, তাঁরা ভোট প্রচারে গিয়ে অনন্তবাবুর হয়ে ভোট চাইবেন তো?

অনন্তবাবু অবশ্য সে সব মানতে রাজি নন। দলের অসন্তোষ নিয়ে প্রশ্ন শুনে, অনন্তদেববাবুর মুখে বিরক্তিই ফুটল। সিগারেট জ্বালিয়ে দেশলাই কাঠি ছাইদানিতে গুঁজে ঘুম জড়ানো স্বরেই অনন্তবাবু বললেন, ‘‘ও সব এখন কোনও বিষয়ই নয়। সব মিটে গিয়েছে। কিছু হয়ত ভুল বোঝাবুঝি ছিল। এখন সব ঠিক।’’

এ দিকে লাল আর কংগ্রেসের তেরঙ্গা ঝান্ডা একসঙ্গে কাঁধে নিয়ে চৈত্রের চড়া রোদে বার্নিশের তিস্তা পাড়ে হেঁটে যাচ্ছিলেন এক আরএসপি কর্মী। তিস্তা চরে থাকা বিভিন্ন বাড়ির বেড়ার ফাঁকে গুঁজে দিচ্ছিলেন এক একটি পতাকা। নীচু স্বরে সেই কর্মী জানালেন, ‘‘মেটেনি কিছুই। ওঁরা বলছে এবার ভোট আমাদেরই দেবে।’’ ওঁরা মানে তৃণমূলের কিছু পুরোনো নেতা-কর্মী। অনন্তবাবুরা দল ছাড়ার পরে পুরোনো গড় দখল করতে ঘরের মেয়েকে এবার ময়নাগুড়িতে প্রার্থী করেছে আরএসপি। প্রাক্তন আরএসপি বিধায়কের মেয়ে ছায়া রায় কর্মসূত্রে জলপাইগুড়িতে থাকেন। শিক্ষিকা, স্বচ্ছ ভাবমূর্তি। ছায়াদেবী বলছেন, ‘‘ময়নাগুড়ির বিষয়টি কিন্তু আলাদা। এখানে মানুষের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা হয়েছে। এক দল থেকে জিতে অন্য দলে যোগ দেওয়ার ঘটনা রয়েছে। বিভিন্ন সরকারি প্রকল্পে দুর্নীতি রয়েছে। তাই তৃণমূলের প্রার্থীর বিরুদ্ধে তৈরি হওয়া ক্ষোভ থেকে মানুষ জোট বেধেছেন।’’

গত লোকসভা-বিধানসভা উপনির্বাচনে ভোটের নিরিখে তৃণমূল এগিয়ে থাকলেও, এক অন্য জোটের সমীকরণের আতঙ্ক তাড়া করে বেড়াচ্ছে অনন্তবাবুকে। বাম-কংগ্রেসের জোটে তৃণমূলের একটা অংশও যোগ দেবে না তো? অবশ্য প্রকাশ্যে সে কথা মানতে চাইছেন না অনন্তবাবু। তাঁর কথায়, ‘‘ধুর ধুর! সে সব কোনও বিষয় নেই। আমার চিন্তা শুধু মার্জিন বাড়ানো।’’ তবে কান পাতলে শোনা যাচ্ছে অন্য কথা। অনন্তবাবুর প্রচারের ছায়াসঙ্গী তথা দলের পর্যবেক্ষক বিশু সেন তো বলেই ফেললেন, ‘‘দাদা এখন দিনে সাত থেকে আট প্যাকেট সিগারেট খাচ্ছেন। আমরা কতো না করি, শুনলে তো!’’

তাই পুড়েই চলেছে প্যাকেট প্যাকেট সিগারেট। অগত্যা।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement