প্রীতি মিনজ। —নিজস্ব চিত্র।
“টিনের ঘরে কিন্তু খুব গরম, বসতে পারবেন?” শ্যামলা বরণ মেয়ে। বয়স সাতাশ। নিরাভরণ হাত। কপালে টিপ নেই। বাঁ হাতে সরু, কালো বেল্টের ঘড়ি। আশ্বিনের রোদে তেতেপুড়ে এলেন মেয়েটি। এমন রোদে কেনবের হওয়া!
“পুলিশ ডেকেছিল যে!” ক্লান্ত মুখে মেয়েটি হাসেন। “স্কুলে স্কুলে পুলিশ বিজয়িনী নামে অনুষ্ঠান করাচ্ছে, ওখানে গ্রামের, চা বাগানের ছাত্রীদের আত্মরক্ষা, ছোট বয়সে বিয়ে না করা, মোবাইলে কত ফাঁদ পাতা থাকে, সে সব শেখানো হয়। আমাকেও ডাকে, শেখাতে।” টিনের চাল, টিনের দেওয়াল, একটি বড় ঘর। ঘরে পাশাপাশি দু’টো বিছানা। আলনা, আয়না, নিচু টেবিল। তাতে কাপ, মেডেল। কিছু মেডেল মেঝেতে গড়াগড়ি যাচ্ছে।
কী শেখান এই সাতাশ বছরের মেয়ে? “আমাকে বলা হয়েছে, পাচার, অল্প বয়সে বিয়ে এই সব নিয়ে বলতে। তাই বলি। তবে যেটা বলবই বলব, সেটা হল ন্যাপকিন, স্যানিটারি প্যাড। অল্পবয়সি ছাত্রীদের বলি স্যানিটারি প্যাড ব্যবহার করতে। যখন বলি ওরা লজ্জা পায়। চোখ সরিয়ে নেয়।” মেয়ের চোখ দু’টো জ্বলজ্বল করে। হয়তো জ্বলজ্বল করে না। ঘরের অন্ধকারে মনে হয় মাত্র। ঘরের দুটো বাল্বে সবটুকু অন্ধকার কাটে না।
“প্রীতি ম্যাম, আছো?” বলতে বলতে দমকা হাওয়ার মতো ঘরে ঢুকে পড়ে দু’টি কিশোরী। ইশারায় ওদের বসতে বলেন সাতাশ বছর। “ওরা আমার ছাত্রী। ওরাও চা বাগানের মেয়ে। বাড়ি থেকে নাচের স্কুলে পাঠানোর খরচ দিতে পারে না। আমি ওদের এমনিই শেখাই। এ বার ওরা মহিষাসুরমর্দিনী করবে। পুজো তো এসে গেল।”
কাঠামবাড়ির জঙ্গলের রাস্তায় দু’ধারে কাশফুল। ওদলাবাড়িতে পৌঁছে দেওয়া জাতীয় সড়কের মাঠে ডিভাইডারের একটু মাটি পেয়ে জন্মেছে কাশবন। ওদলাবাড়ির পাওয়ার হাউস পাড়াতেও পুজো মণ্ডপ বাঁধা হচ্ছে। পাশেই প্রীতির টিনের বাড়ি। ঘরের মেঝেতে বসে পড়ে দুই কিশোরী ছাত্রী।
“ওর বাড়িতে ন্যাপকিন দিতে গিয়েছিলাম,” সামনে বসা এক কিশোরীকে দেখান প্রীতি। “শুধু দিলেই হয় না। ঠিকঠাক ব্যবহার করতে বলতে হয়। না হলে কোনও লাভ নেই। সে সব বলতে তাই এটা-সেটা গল্প করি। তখনই জানতে পারি ওর নাচ শেখার ইচ্ছে, ওর মা-বাবাও নিরুপায়। খরচ দেবে কে? তার পর থেকে বাড়িতে নাচের ক্লাস শুরু করি।” ঘাম শুকিয়ে যাওয়া কপালে দুই ভ্রু ধনুকের মতো জোড়া হয়। বলেন, “তবে নাচ শেখার একটা শর্ত দিই। বান্ধবীদের যাদের কেনার ক্ষমতা নেই, তাদের অবশ্যই ন্যাপকিন পৌঁছে দিতে হবে। ওই ওখানে রাখা আছে, ইচ্ছেমতো যে কেউ নিয়ে যেতে পারে।”
আলনার সামনে রাখা পিচবোর্ডের বাক্স। তাতে উপচে পড়ছে স্যানিটারি ন্যাপকিন। মেয়ের হাসি থামে না। “জানেন, বড়দিন, দেওয়ালি উৎসবের সময়ে স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা, কত এমনিই মানুষজন চা বাগানে, বস্তিতে চকলেট, খাবার নিয়ে যায়। আর আমি নিয়ে যাই ন্যাপকিন। সবাই যে কেমন করে তাকায়!” বলতে বলতে ঝোরার মতো হাসি। “ওদের খুব কষ্ট জানেন। এই গরিব মেয়েগুলোর। আমি তো প্রথমে ন্যাপকিন বিলি করতাম না। স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের হয়ে পাচার আটকানো নিয়ে সমীক্ষার কাজ করতাম। এক দিন কী হল, আমি একটা চা বাগানে গিয়েছি সমীক্ষার কাজে, দু’হাজার আঠেরো সাল, একটু দূরের চা বাগান....”
বাগিচার মাঝখানে পাথর বিছানো আঁকাবাঁকা পথে এক দল মেয়ে। পিঠে চা পাতা ঠাসা ব্যাগ। যাবে কারখানায়, পাতা জমা করতে। একটি মেয়ে দলছুট। তার পায়ে যেন হাতি বাঁধার শেকল জড়ানো। বয়স, সতেরো হবে! এক পা ফেলে, থামে, আবার এক পা। “কী হয়েছে?” মেয়েটির সামনে এক তরুণী। মেয়ে নিরুত্তর। তরুণী ভাবেন, আদিবাসী মেয়ে বাংলা বোঝে না। তিনি নিজেও চা বাগানের মেয়ে, আদিবাসী। জিজ্ঞেস করেন, “ছোড়ি তোর কা হইয়ে?” মেয়েটি তবু কিছু বলে না। এ বার কাঁধে হাত রেখে জিজ্ঞেস করেন, “কা হইয়ে রে তোর?” মেয়েটা নিচু মুখে উত্তর দেয়, “শরীর খারাপ।” কী হয়েছে, জ্বর, পেট খারাপ, মাথাব্যথা?
“না! শরীর খারাপ।”
দুপুরের নিঝুম চা বাগানে হাওয়া খেলে না। তবু নর্দমার পাশে হেলায় ফোটা কাশফুল তাকিয়ে থাকে নতুন মেঘের দিকে। কারও কণ্ঠ ভেসে আসে! “মা, ও মা, আমার শরীর খারাপ!” চা বাগানের মাঝে ব্যথায় কুঁকড়ে আসা একটি মেয়ের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে তরুণী চিনে নেন সেই কণ্ঠস্বর। তারই। তখন ছোটবেলা, শরীর খারাপ হত চার-পাঁচ দিন। বিছানা থেকেই নামত না। মা এসে বিছানাতেই খাইয়ে দিত, পরিষ্কার করিয়ে দিত। সে বিছানায় বসে শুধু ছবি আঁকত। মেঘের, বৃষ্টির, শিউলি ফুলের ছবি... যে ছবিতে ব্যথা নেই। সেই কত দিন আগের সব কথা এসে দুই মেয়ের মাঝে দাঁড়ায় চা বাগানে।
তরুণীর ঘোর কাটে। মেয়েটিকে জিজ্ঞেস করেন, “শরীর খারাপে কী ব্যবহার করিস? বল না, লজ্জা কী?” খানিক চুপ থেকে মেয়ে বলে, “গরম কাপড়।” বদলাস না? মেয়েটি উত্তর দেয়, “না! খুব অস্বস্তি হয়। শরীরে জ্বালাপোড়া লাগে।”
....
তার পর? “তার পর ঘট ভাঙল।” পাশ থেকে বলে উঠলেন প্রীতি ম্যামের মা, চন্দ্রমণি ওরাওঁ। “হ্যাঁ ঘট ভাঙল। প্রীতি তখন মেকআপ করাত, কনে সাজাত। এই মফস্সল এলাকায় বেশ রোজগারও হত। সে সব ঘটে জমাত। চা বাগান থেকে ফিরে ঘট ভেঙে ন্যাপকিন কিনে পরের দিন ভাইকে নিয়ে ওই বাগানেই গেল। তার পর থেকে চলছে। কত লোকে ওকে এখন ডাকে, অনুষ্ঠানে নিয়ে যায়।”
সামনে বসা এক কিশোরী বলে, “জানেন, প্রীতি ম্যামকে কী বলে ডাকে বাইরে? প্যাড ম্যাডাম।” চন্দ্রমণি বলেন, “ওই একটা সংস্থা পাহাড়ে নিয়ে গিয়ে ওকে সংবর্ধনা দিল, প্যাড ম্যাডাম নামটাও দিল, এক বস্তা ন্যাপকিনও দিল। এ সব নিয়েই থাকে মেয়েটা, ইঞ্জিনিয়ারিংটাও পড়াতে পারলাম না। আমরা গরিব তো, ওর বাবা প্রাইভেট গাড়ি চালায়, আমার অসুখ। রান্নাবান্নাও প্রীতি করে, তার পর বাগানে-বাগানে, স্কুলে ন্যাপকিন দিতে যায়।”
এত ন্যাপকিন কেনার টাকা আসে কোথা থেকে? “এখন তো অনেকেই জানে। তাই লোকে সাহায্য করে। কলকাতার তিন জন ম্যাডাম মাঝেমধ্যেই সাহায্য করেন, বেঙ্গালুরু থেকেও সাহায্য আসে। আরও অনেকে দেয়।” অনেকক্ষণ পরে ফের কথা বলেন প্রীতি। বিভিন্ন ব্যক্তি, সংস্থার পাঠানো অর্থে তবে ন্যাপকিন জোগাড় হয়? “না, না, টাকা নিই না।” কোমর সোজা করে বসেন প্রীতি। “শুধু ন্যাপকিন নিই। যিনি যতগুলি পারেন ন্যাপকিন পাঠান। হাতে, পোস্টে, ক্যুরিয়ারে। এক টাকাও নিইনি কারও থেকে। বাকিটা আমি কিনি, আমি এখনও মেকআপ করাই, নাচের ক্লাসও করাই।”
মা ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ার কথা বলছিলেন না! ২০১০-এ মাধ্যমিক পাশ করে প্রীতি পড়তে যান শিলিগুড়ি মহিলা আইটিআই-তে। সেখানে দ্বিতীয় হয়ে পরীক্ষা দিয়ে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে কলকাতা। ইচ্ছে ছিল স্নাতকোত্তরও করার। হয়নি। মা বলেন, “বাবা ড্রাইভার। কী করে করবে। বেসরকারি সংস্থায় কাজ নিয়ে হায়দরাবাদে গেল। সে বছরই লকডাউন। ফিরে এল।” তার পর?
তার পর প্রীতি মিনজ হয়ে গেলেন ‘প্যাড ম্যাডাম’। হাসেন চন্দ্রমণি, হাসেন বাবা বাবলু। ভাই বান্টি বাড়ি থাকলে সে-ও হয়তো হাসত। কিশোরী দুই ছাত্রীও হাসে। হঠাৎ প্রীতি মুখ নামান দুই করতলে। ‘ও কী প্রীতি, কী হল তোর! কী হোয়াক প্রীতি!’ মা ডাকেন।
প্রীতির দু’হাত চুঁইয়ে ধারা নেমেই চলছে। “এক বার একটা চা বাগানে লোকজন দা, বঁটি নিয়ে তেড়ে এসেছিল। বলেছিল, ওদের মেয়েদের ন্যাপকিন দেওয়া যাবে না। আমি বললাম, নোংরা কাপড় ব্যবহার করে সব ক’টা মেয়ে সংক্রমণের রোগে ভুগছে! আমাকে তাড়া করল। আর এক বার....” চোখের নদী পাগলপারা। “সেটাও চা বাগানে, মেয়েদের বোঝাচ্ছি, ‘শরীর খারাপ নয়, পিরিয়ড বলবে। পিরিয়ড হলে কোনও কাজে বাধা নেই। সব কাজ করতে পারবে, রান্না, পুজো, সব...।’ পিছন থেকে কত জন অপমান করল। সকলের সামনে কেঁদে ফেলেছিলাম। ছুটে বাড়ি এসে বলেছিলাম, মা আমি আর কাউকে ন্যাপকিন দিতে যাব না।”
তার পর? “মা, বাবা, ভাই, সকলে উৎসাহ দিল। আমি যাইনি বলে চা বাগানের কয়েকটা মেয়ে বাড়ি এল ন্যাপকিন চাইতে। ওদের মুখে দেখলাম, সংক্রমণ থেকে মুক্তির হাসি, স্বাস্থ্যও ভাল হচ্ছে ওদের। চোখের জল মুছে আবার বেরোলাম। কেউ কিছু বললেও এখন আর কাঁদি না।”
পাশে মণ্ডপে বাঁশ বাঁধা হচ্ছে। পেরেক ঠোকার শব্দ। প্রীতি জানালেন, পুজোর সব দিন কোনও না কোনও অনুষ্ঠানে ডাক পড়ে। এ বারেও ডাক এসেছে। মণ্ডপে দাঁড়িয়ে এ বছরও বলবেন ন্যাপকিন ব্যবহারের কথা। মেয়েদের জানাবেন, পিরিয়ড হলেও তোমরা কেউ অশুচি নও। মণ্ডপে এ সব কথা বলতে কেউ আপত্তি তোলে। প্রীতি বলেন, “আমি সঙ্গে সঙ্গে বলি, মা দুর্গাও মহিলা। মা কামাখ্যারও তো মাসিক হয়। তার বেলা....! বলুক গে, এখন আমার সঙ্গে চা বাগানের মেয়েরা আছে, যারা এখন বলে দেয়, আমার পিরিয়ড চলছে, মাসিক হয়েছে।”
চোখের কোণে হাসির ঝিলিক প্যাড ম্যাডামের। বলতে থাকেন, “এ বারও আশেপাশের সব চা বাগানের মণ্ডপে যাব। বলব ন্যাপকিন ব্যবহারের কথা।” কচি সবুজ চা বাগিচায় শরতের রোদের মতো ছড়িয়ে পড়ে হাসি।