ভাবনা মাথায় এলেও এত দিন বাস্তবায়িত হয়নি। ঝুলি থেকে বিপদ বেরিয়ে আসার পরে এখন প্রশ্ন উঠেছে, কেন হয়নি?
গার্ডেনরিচের জাহাজ কারখানার (গার্ডেনরিচ শিপবিল্ডার্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ার্স, সংক্ষেপে জিআরএসই) সুরক্ষায় কেন্দ্রীয় শিল্প-নিরাপত্তা বাহিনী (সিআইএসএফ) মোতায়েনের কথা ভাবা হয়েছিল বহু আগে। সেটা আর করে ওঠা যায়নি। সম্প্রতি পাক গুপ্তচর সংস্থা আইএসআইয়ের এজেন্ট সন্দেহে কারখানার এক ঠিকা শ্রমিক-সহ একাধিক লোক গ্রেফতার হয়েছে। তাদের চক্র মারফত বেশ কিছু যুদ্ধজাহাজের নক্শা পাচার হয়ে থাকতে পারে বলে আশঙ্কাও জেগেছে গোয়েন্দা মহলে।
এমতাবস্থায় জিআরএসই-র গোপনীয়তা ও সুরক্ষা-ব্যবস্থায় নানা ফাঁক-ফোকর যেমন প্রকট হচ্ছে, তেমন সংস্থার বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। আর জাতীয় নিরাপত্তায় এ হেন বিপদের প্রেক্ষাপটেই ফের সামনে এসে পড়েছে সিআইএসএফ মোতায়েনের প্রসঙ্গ। গুরুত্বপূর্ণ কারখানাটিতে এত দিন সিআইএসএফ মোতায়েন করা হল না কেন?
প্রতিরক্ষা মন্ত্রক সূত্রের ব্যাখ্যা: জিআরএসই আদতে মন্ত্রকের অধীনস্থ রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা। সেখানে সিআইএসএফ রাখলে খরচ সংস্থাকেই জোগাতে হবে। ওই বিপুল বোঝা এড়াতেই সংস্থা কর্তৃপক্ষ এ ব্যাপারে খুব বেশি সক্রিয় হননি বলে সূত্রটির দাবি।
পাশাপাশি অন্য তত্ত্বও বাতাসে ভাসছে। মন্ত্রকের একাংশের অভিমত, সিআইএসএফের ‘বাড়াবাড়ি’ নিয়ে হামেশা অভিযোগ ওঠে। এতে শ্রমিক অসন্তোষ দেখা দেয়, ব্যাহত হয় উৎপাদন। ‘‘আমাদের অভিজ্ঞতা বলছে, পশ্চিমবঙ্গের ক্ষেত্রে এই জাতীয় অশান্তির আশঙ্কা আরও বেশি।’’— পর্যবেক্ষণ এক প্রতিরক্ষা-কর্তার।
নৌ-সেনার একাংশ অবশ্য এ সব যুক্তি মানতে নারাজ। তাদের বক্তব্য, জাতীয় নিরাপত্তা যেখানে জড়িত, সেখানে কড়াকড়ি করতেই হবে। শ্রমিক সংগঠনগুলোকে বোঝাতে হবে, দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষার স্বার্থেই কড়াকড়ি জরুরি। বৃহস্পতিবার দিল্লিতে গার্ডেনরিচ-কাণ্ড সম্পর্কে নৌ-প্রধান অ্যাডমিরাল রবিন ধবনকে প্রশ্ন করা হয়েছিল। তিনি বলেন, ‘‘তদন্ত চলছে। জিআরএসই-র নিরাপত্তা ব্যবস্থা খতিয়ে দেখা হচ্ছে।’’
বস্তুত জিআরএসই-র ঠিকা শ্রমিক ইরশাদ আনসারি পাক চর সন্দেহে গ্রেফতার হওয়ায় নৌবাহিনী যথেষ্ট উদ্বিগ্ন। পশ্চিমবঙ্গে নৌ-সেনার ভারপ্রাপ্ত অফিসার কমোডর রবি অহলুওয়ালিয়া সম্প্রতি সংস্থার শীর্ষ কর্তাদের সঙ্গে দেখা করেছেন। কারখানার নিরাপত্তাবৃদ্ধির বিষয়ে তাঁদের আলোচনা হয়েছে। এ দিন কমোডর অহলুওয়ালিয়া বলেন, ‘‘যেখানে যুদ্ধজাহাজ বানানো হচ্ছে, সেখানে এক জন সন্দেহভাজন অবাধে ঘুরে বেড়ালে খুবই চিন্তার কথা।’’ কমোডর এ-ও জানিয়েছেন, জিআরএসই যে হেতু রাষ্ট্রায়ত্ত কোম্পানি, তাই নৌ-সেনা তাদের সুরক্ষা সংক্রান্ত পরামর্শই শুধু দিতে পারে, এর বেশি কিছু নয়। যদিও তাঁর আশা, উদ্ভুত পরিস্থিতির প্রেক্ষিতে জিআরএসই-কর্তৃপক্ষ নিজেই নিরাপত্তা বাড়াতে উদ্যোগী হবেন।
তার কিছুটা ইঙ্গিত অবশ্য দেখা যাচ্ছে। নৌ-সেনা সূত্রের খবর, জিআরএসই-তে নির্মীয়মাণ জাহাজে যে কেউ যাতে উঠে পড়তে না-পারে, সে দিকে কড়া নজর দেওয়া হচ্ছে। ঠিকা শ্রমিকদের ক্ষেত্রে পুলিশ ভেরিফিকেশন রিপোর্টে সবিশেষ গুরুত্ব দিতে বলা হয়েছে। সূত্রের খবর: কারখানা কর্তৃপক্ষের তরফে ইতিমধ্যে ঠিকা শ্রমিকদের বলা হয়েছে দ্রুত পুলিশ ভেরিফিকেশন রিপোর্ট জমা দিতে। কলকাতা পুলিশের সঙ্গেও যোগাযোগ করা হয়েছে।
জিআরএসই-র আইএনটিইউসি নেতা মোক্তার আহমেদের মতো অনেকে এই তৎপরতাকে স্বাগত জানালেও এর কার্যকারিতা নিয়ে সন্দিহান সংস্থার কিছু মহল। যেমন এক অফিসারের প্রশ্ন, ‘‘চরেরা তো ভোটার আইডি, এমনকী পাসপোর্টও জাল করেছিল। পুলিশের রিপোর্ট ঠিকঠাক থাকবে, তার গ্যারান্টি কী? তা ছাড়া নিয়োগের পরেও তো কেউ চর হয়ে যেতে পারে?’’
এমন বিবিধ সংশয়, আশঙ্কার মাঝে ধৃতদের জেরার পালা অব্যাহত। গোয়েন্দাদের দাবি: পাকিস্তান থেকে আসা চর মহম্মদ ইজাজ ওরফে কালামকে জাল পরিচয়পত্র তৈরি করে দিয়েছিল ইরশাদ ও তার শ্যালক জাহাঙ্গির। মেরঠে উত্তরপ্রদেশ পুলিশের হাতে ইজাজ ধরা পড়ায় এটা জানা গিয়েছে। জাল আইডি-চক্রের চাঁই সন্দেহে বুধবার কলকাতায় ধরা পড়েছে এক জন। লালবাজারের এসটিএফের অভিযোগ, শেখ বাদল নামে ওই ব্যক্তি কলকাতায় পাসপোর্ট অফিসের দালাল, এবং ইরশাদদের হয়ে সে-ই ইজাজের জন্য জাল ভোটার কার্ড বানিয়েছে।
এ দিন বাদলকে ব্যাঙ্কশাল কোর্টে তোলা হয়েছিল। সরকারি কৌঁসুলি অভিজিৎ চট্টোপাধ্যায় সওয়ালে বলেন, ইরশাদদের জেরা করেই বাদলের নাম জানা গিয়েছে। সে দেশবিরোধী কাজে যুক্ত। অন্য দিকে বাদলের কৌঁসুলি রাজেশকুমার গুপ্তের দাবি, তাঁর মক্কেলকে ফাঁসানো হয়েছে। শুনানি শেষে শেখ বাদলকে ১৪ ডিসেম্বর পর্যন্ত পুলিশি হেফাজতে পাঠিয়েছেন বিচারক সঞ্জয়রঞ্জন পাল।