প্রায় দু’মাস ধরে নিখোঁজ শিলিগুড়ির জিম-পার্লার কর্মী সঙ্গীতা কুণ্ডু। তাঁকে অপহরণের অভিযোগে মামলাও রুজু হয়েছে প্রায় একই সময়ে। অথচ এর মধ্যে তদন্ত একচুলও এগোয়নি বলে অভিযোগ সঙ্গীতার বাড়ির লোকেদের। ওই তরুণী যে সংস্থায় কাজ করতেন, তার কর্ণধার পরিমল সরকারের বিরুদ্ধেই অভিযোগ তাঁদের। আরও অভিযোগ, কয়েক জন প্রভাবশালী ব্যক্তি আড়াল থেকে কলকাঠি নাড়ায় পুলিশ সব কিছু ধামাচাপা দিতে চাইছে। পুলিশ অফিসারদের একাংশ, শাসক দলের একাধিক নেতা-মন্ত্রী, মন্ত্রীর আপ্ত সহায়ক, বিরোধী দলের এক নেতা, তাঁর ভাই-সহ অনেকের ভূমিকা নিয়েই ধন্দে পড়েছেন সঙ্গীতার পরিবার ও শুভার্থীরা। পরিমলবাবু অবশ্য গোড়া থেকেই দাবি করছেন, তিনি নির্দোষ।
সঙ্গীতা যাঁর বিধানসভা এলাকার বাসিন্দা, সেই পর্যটনমন্ত্রী গৌতম দেব বলেন, ‘‘অন্তর্ধান রহস্যের সমাধান করতেই হবে। সেটা পুলিশকে বারবার বলেছি।’’ শিলিগুড়ির সিপি চেলিং সিমিক লেপচা জানান, তাঁকেও পর্যটনমন্ত্রী জানিয়েছেন। তদন্ত কেন দু’মাসেও এগোয়নি? সিপি-র জবাব, ‘‘তদন্ত এগোচ্ছে।’’
সঙ্গীতার বাড়ির লোকের কিন্তু দাবি, তদন্ত এতটুকু এগোয়নি। তাঁদের সন্দেহের প্রথম কারণ, পরিমলকে হেফাজতে নিয়ে জেরা তো দূরের কথা, দু’মাস অবধি জবানবন্দিও নেওয়া হয়নি। কিন্তু, পরিমলের আগাম জামিনের শুনানির আগেই ‘কেস ডায়েরি’ আদালতে পাঠানো হয়েছে। দ্বিতীয়ত, বিভিন্ন দরজায় ঘুরতে ঘুরতে সঙ্গীতার স্বজনেরা কোথাও শুনেছেন, ‘পরিমল বড় ভাল ছেলে’, কোথাও শুনেছেন, ‘ও তো পুলিশ ফ্রেন্ড’। আবার কোথাও— পরিমলকে একাধিক মন্ত্রী খুব ভালবাসেন। কয়েক জন পুলিশ অফিসার, নেতা প্রায় এক সুরে বাড়ির লোককে জানান, ‘দেশে এমন কত মেয়েই তো নিখোঁজ হয়!’ তৃতীয়ত, শাসক দলের যে সব কাউন্সিলর ছোটখাটো ব্যাপার হলেও মিটিং-মিছিল করেন, তাঁরাও সঙ্গীতার ব্যাপারে মুখে কুলুপ। তাই বিপন্ন বোধ করছেন নিখোঁজ তরুণীর আত্মীয়রা।
শনিবারই নাগরিক মিছিলের প্রস্তুতি নেয় কোর্ট মোড়ের একটি ক্লাব। কিন্তু, শেষ মুহূর্তে নানা কারণ দেখিয়ে অনেকেই পিছিয়ে যান। বেশ কয়েক জন নেতা আড়াল থেকে এ ধরনের মিছিলে না-যাওয়ার ফতোয়া দিয়েছেন বলে পরিবারের অভিযোগ।
রীতিমতো সন্ত্রস্ত সঙ্গীতার মা অঞ্জলি দেবী বলেছেন, ‘‘পর্যটনমন্ত্রী দু’মাসে একবারও আমাকে একটা ফোন করলেন না। অথচ শুনেছি পরিমল মিসিং ডায়েরি করার পরে এক মন্ত্রীর দফতর থেকে ফোন গিয়েছিল।’’ তাঁর বক্তব্য, ‘‘কংগ্রেস বিধায়ক শঙ্কর মালাকারও খোঁজ নিলেন না। ভাইচুং ভুটিয়ার কাছে চিঠি দিতে আমার ছেলেকে দিনের পর দিন ঘুরতে হচ্ছে। কেউ বলল মোমবাতি মিছিল করবে, পরে জানালো তা হবে না।’’ তাঁর আক্ষেপ, ‘‘এখন শেষ ভরসা মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। কালীঘাটে গিয়ে ওঁকে সব জানাব।’’
পরিমলবাবুর দাবি, ১৭ই রাত ৯টা নাগাদ তিনি সঙ্গীতাকে শেষবার দেখেন। কিন্তু ওই অ্যাপার্টমেন্টের আবাসিকদের কয়েক জন জানান, পরিমলবাবুকে সেখানে মাঝেমধ্যেই গভীর রাত অবধি দেখা যেত। পরিমলবাবু ঘটনার ৮ দিন পরে মিসিং ডায়েরি করায় তাই অনেকেই বিস্মিত। এর পরে পরিমলবাবুর বিরুদ্ধে অপহরণের অভিযোগে মামলা হয়। এর মধ্যে পর্যটনমন্ত্রী ও সিপি-কে দিয়ে ওই সংস্থার দুটি জিমের উদ্বোধন করানো হয়। সে দুটির ট্রেড লাইসেন্স নেই বলে মেয়র অশোক ভট্টাচার্যের দাবি। একটি জিমের উপরে অনুমতি ছাড়াই ‘ম্যাসাজ পার্লার’ চলছে, অভিযোগ পুরসভার। মেয়র বলেন, ‘‘শীঘ্রই নোটিস পাঠিয়ে সব জানতে চাইব। তার পরে পদক্ষেপ করব।’’
নেতা-কর্তাদের অনেকেই অবশ্য প্রভাবশালী তত্ত্ব মানতে নারাজ। পর্যটন মন্ত্রী জানান, তিনি বহুবার সিপিকে বলার পরেও কেন কড়া পদক্ষেপ হচ্ছে না, সেটাই বুঝতে পারছেন না। তাঁর আপ্ত সহায়ক অংশু রায়ের দাবি, মামলার যাতে নিরপেক্ষ তদন্ত হয়, সে জন্য তিনিও ফোন করেন। বিধায়ক শঙ্করবাবু জানান, আড়ালে নেতা-মন্ত্রী-পুলিশের মাথা যিনিই থাকুন, সব সামনে আনুক পুলিশ। বনমন্ত্রী বিনয় বর্মন, উত্তরবঙ্গ উন্নয়ন মন্ত্রী রবীন্দ্রনাথ ঘোষ, দুজনেই আলাদা ভাবে এক সুরে জানান, ট্রেড মিল কেনার সূত্রে পরিচয়। ‘‘ওঁর দোকান থেকে জিনিস কিনেছি বলেই ঘনিষ্ঠ— এটা ভাবা ঠিক নয়। ওঁর বিরুদ্ধে অপহরণের মামলা হয়েছে। পুলিশ আইন মেনে পদক্ষেপ করুক।’’
কেন প্রভাবশালী
পরিমল সরকারের ফেসবুক অ্যাকাউন্টে ১৯ অক্টোবর পর্যন্ত প্রশাসনের শীর্ষ কর্তাদের সঙ্গে ছবি দেখা গিয়েছে। তাঁরা হলেন: শিলিগুড়ির পুলিশ কমিশনার চেলিং সিমিক লেপচা, পর্যটন মন্ত্রী গৌতম দেব, উত্তরবঙ্গ উন্নয়নমন্ত্রী রবীন্দ্রনাথ ঘোষ। এ ছাড়া একাধিক সাব ইন্সপেক্টর, ইন্সপেক্টর, আইপিএস, প্রাক্তন দুই সিপি জগমোহন, মনোজ বর্মার শরীরচর্চার ছবিও ছিল।