কলকাতা থেকে হেলিকপ্টারে শিল্পশহর দুর্গাপুর যাওয়ার ভাড়া ছিল ৪২০০ টাকা। আট আসনের কপ্টারে যাত্রী মিলছিল উড়ান-পিছু কুল্লে ২-৩ জন। সম্প্রতি ভাড়া কমিয়ে ১৫০০ টাকা করেছে রাজ্য সরকার। তাতেও বাড়েনি যাত্রিসংখ্যা!
আর এক শিল্পশহর হলদিয়ার দশা আরও খারাপ। গত দু’সপ্তাহে এক জনও যাত্রী পাওয়া যায়নি বলে সেখানে কপ্টার পরিষেবা আপাতত বন্ধ।
এ রাজ্যে শিল্পের দশা কী, সেটা এই ছবিই দেখিয়ে দিচ্ছে চোখে আঙুল দিয়ে। গুজরাত, মহারাষ্ট্রের মতো রাজ্যে যখন ক্রমেই ফুলেফেঁপে উঠছে কপ্টার ও বিমান পরিষেবা, সেখানে বিপুল পরিমাণ সরকারি ভর্তুকি দিয়েও যাত্রী জুটছে না পশ্চিমবঙ্গে।
কেন্দ্রীয় সংস্থা পবন হংসের কাছ থেকে ৫০ লক্ষ টাকায় মাসে ৪০ ঘণ্টার জন্য দু’ইঞ্জিনের একটি কপ্টার ভাড়া নিয়েছে রাজ্য সরকার। সাধারণ ভাবে ৮০ ঘণ্টার কম সময়ের জন্য কপ্টার তারা ভাড়া দেয় না। কিন্তু মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের অনুরোধে পশ্চিমবঙ্গের জন্য নিয়ম শিথিল করেছিল তারা। গোড়ায় ঠিক হয়েছিল, মুখ্যমন্ত্রী ও অন্য মন্ত্রী-আমলাদের জন্য ব্যবহার করা হবে এই কপ্টার। বিপর্যয় মোকাবিলার কাজেও লাগানো হবে। কিন্তু কয়েক মাস পরে দেখা যায়, সরকারি কাজে কপ্টারের ব্যবহার হচ্ছে নামমাত্র। অথচ মাসে ৪০ ঘণ্টার ভাড়া দিতেই হচ্ছে।
এই অবস্থায় কলকাতা থেকে রাজ্যের বিভিন্ন শহরে কপ্টার পরিষেবা চালু করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। তাতে দুর্গাপুর, হলদিয়ার মতো শিল্পশহর যেমন আছে, তেমনই আছে মালদহ, গঙ্গাসাগর, শান্তিনিকেতনের মতো পর্যটন কেন্দ্র। এ ছাড়া রয়েছে উত্তরবঙ্গের বালুরঘাট। মালদহ-বালুরঘাট-গঙ্গাসাগর-শান্তিনিকেতনে সপ্তাহে এক দিন, দুর্গাপুরে দু’দিন, হলদিয়ায় দু’সপ্তাহে এক দিন করে পরিষেবা চালু হয়। ভাড়ায় বিপুল ভর্তুকিই দিচ্ছে সরকার। বেহালা থেকে মালদহ যেতে খরচ ১৩০০ টাকা। অন্যত্র ১৫০০। শুধু দুর্গাপুরে কপ্টারের চাহিদা বেশি হবে এই আশায় ভাড়া রাখা হয়েছিল ৪২০০ টাকা। তবু প্রতিটি উড়ানে সব টিকিট বিক্রি হলেও রাজ্যের খরচের ১০ শতাংশও উঠত না। কিন্তু তার পরেও যাত্রী নেই অর্ধেক রুটে। মালদহ, বালুরঘাট ও গঙ্গাসাগরে লোক হচ্ছে মন্দের ভাল। উত্তরবঙ্গের কিছু ব্যবসায়ী কপ্টারে মালদহ ও বালুরঘাট যান সময় বাঁচাতে। আর গঙ্গাসাগরে কপিলমুনির আশ্রমে সারা বছরই কিছু না কিছু পুণ্যার্থী আসেন। বারবার বাস-ভেস্ল বদল করে সেখানে যাওয়ার বদলে সরাসরি কপ্টারে যাওয়া পছন্দ করেন কেউ কেউ।
কিন্তু অন্যত্র যাত্রীর আকাল কেন? এ প্রশ্নের কোনও সদুত্তর নেই নবান্নের কর্তাদের কাছে। তবে রাজ্যের শিল্পমহল বিস্মিত নয়। তাঁদের বক্তব্য, কী শিল্পে, কী পর্যটনে এ রাজ্য ক্রমশ পিছিয়ে পড়ছে। যাত্রী মিলবে কোথা থেকে! লগ্নিকারীদের একাংশের মতে, রাজ্য জুড়ে শিল্পাঞ্চলে হুমকি, তোলাবাজির ঘটনা ঘটছে। বন্ধ হয়ে যাচ্ছে একের পর এক কারখানা। হলদিয়া ও দুর্গাপুরে শিল্পের এক সময়ের রমরমা এখন প্রায় অস্তমিত। নতুন শিল্প দূরের কথা, ওই শহরে ঐতিহ্যশালী কারখানা-সহ অনেক বড় ও মাঝারি শিল্প হয় বন্ধ, অথবা রুগ্ণ। হলদিয়া পেট্রোকেমিক্যালস ঘিরেও ঘোর অনিশ্চয়তা। এ দিকে পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে শান্তিনিকেতন পড়ে রয়েছে সেই মান্ধাতা আমলেই।
হলদিয়ায় শিল্পনগরী গড়ে তোলার পরিকল্পনা যখন হয়, তখন কলকাতা থেকে জলপথে দ্রুত সেখানে পৌঁছতে ‘সিলভার জেট’ নামে দ্রুতগামী জলযান (ক্যাটামারান) চালানো শুরু হয়েছিল। কিন্তু হলদিয়ার অবস্থা খারাপ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সেই পরিষেবাও বন্ধ হয়ে গিয়েছে। তারই পুনরাবৃত্তি হচ্ছে কপ্টারে। শিল্পপতিদের মতে, শিল্পায়নের প্রক্রিয়ায় এক শহর থেকে অন্য শহরে দ্রুত পৌঁছতে কপ্টার পরিষেবা খুবই জরুরি। সাধারণ ভাবে কোনও রাজ্যের কপ্টার পরিষেবার হালহকিকৎ দেখে সেখানকার শিল্প পরিস্থিতি সম্পর্কে আঁচ পাওয়া যায়।
মহারাষ্ট্র, গুজরাতের মতো শিল্পোন্নত রাজ্যে শুধু শিল্পকে কেন্দ্র করেই কপ্টার ও বিমান পরিষেবা ফুলে ফেঁপে উঠেছে। ওই সব রাজ্যের বিমান পরিবহণ কর্তাদের কথায়, কপ্টার চালাতে তাঁদের ভর্তুকি দিতে হয় না। সরকারের নিজস্ব বিমান ও হেলিকপ্টার রয়েছে। বিমান পরিবহণের জন্য ওই সব রাজ্যে সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনাও আছে। যেমন, গুজরাতে প্রতিটি প্রত্যন্ত তালুকে স্থায়ী হেলিপ্যাড তৈরির পরিকল্পনা রয়েছে। সে রাজ্যে পাইলট প্রশিক্ষণ কেন্দ্র খোলার কথাও ভাবা হচ্ছে। পশ্চিমবঙ্গে বিমান পরিবহণ দেখভালের জন্য আলাদা কোনও দফতরই নেই।
শিল্পোন্নত রাজ্যে ব্যক্তিগত প্রয়োজনেও ব্যবহার হয় হেলিকপ্টার। এক শহর থেকে অন্য শহরে নিয়মিত উড়ে যান শিল্পপতিরা। ব্যবহার করা হয় এয়ার-অ্যাম্বুল্যান্স। বিয়েতে আকাশ থেকে ফুল ফেলার জন্যও কপ্টার ভাড়া নেওয়া হয়। পশ্চিমবঙ্গে আসার সময় পবন হংস কর্তাদের আশা ছিল, ব্যক্তিগত কারণে অনেকে কপ্টার ভাড়া নেবেন। কিন্তু গত এক বছরে ভাড়া হয়েছে মাত্র দু’তিনটি।
বেঙ্গল চেম্বার এবং সিআইআই-এর প্রাক্তন সভাপতি অলক মুখোপাধ্যায় বলেন, “হায়দরাবাদের মতো দ্বিতীয় শ্রেণির শহর থেকেও সরাসরি ইউরোপের বিমান সংযোগ রয়েছে। অথচ মেট্রো শহর কলকাতা থেকে নেই। কারণ তো একই। শিল্প নেই বলেই এই অবস্থা।” বেঙ্গল ন্যশনাল চেম্বারের প্রাক্তন সভাপতি তেজময় চৌধুরী বলেন, “আমাদের রাজ্যে সে ভাবে শিল্প আসেনি। যা ছিল, তার বেশির ভাগ ধুঁকছে। তা হলে হেলিকপ্টার ভাড়া নেবেন কে?”
সরকারি সূত্রের খবর, কপ্টারের ভাড়া মেটাতে গিয়ে পরিবহণ দফতরের ভাঁড়ারেও টান পড়েছে। বাকি রয়েছে কয়েক মাসের ভাড়া। বকেয়া মেটাতে অর্থ দফতরের কাছে বরাদ্দ বৃদ্ধির আর্জি জানিয়েছে পরিবহণ দফতর। অর্থ দফতর বলছে, সরকারের নুন আনতে ভাতে টান পড়ছে। ফলে বরাদ্দ পাওয়া অনিশ্চিত।
যাত্রী পরিষেবার পরিকল্পনা কার্যত লাটে ওঠার পরে এখন কপ্টারের ভাড়া মেটাতে অন্য উপায় খুঁজছে রাজ্য। পরিবহণ দফতরের এক কর্তা জানিয়েছেন, এখন থেকে কোনও ব্যবসায়ী বা সংস্থা চাইলে কপ্টারটি রাজ্য সরকারের কাছ থেকেও ভাড়া নিতে পারবেন। পরিবহণ দফতরের এক কর্তা জানান, কপ্টারের জন্য রাজ্য সরকার ঘণ্টা প্রতি ১ লক্ষ ২৫ হাজার টাকা ভাড়া দিচ্ছে পবন হংসকে। সেই কপ্টারই রাজ্য এখন ঘণ্টা পিছু ২ লক্ষ টাকায় ভাড়া দিতে চায়। সরকারের এই ঘোষণার পরেও কেউ কপ্টারটি ভাড়া নিতে এগিয়ে আসেননি। উল্টে প্রশ্ন উঠেছে, কোনও সরকার কম টাকায় ভাড়া নিয়ে বেশি টাকায় তা ‘সাব-লেট’ করতে পারে কি?
গত বছরের এপ্রিলে প্রয়াগ নামে এক সংস্থা এক ইঞ্জিনের কপ্টার নিয়ে এসেছিল রাজ্যে। নিয়মিত দুর্গাপুর ও হলদিয়ায় হেলিকপ্টার চালানোর প্রতিশ্রুতিও দিয়েছিল। কিন্তু, দু’মাসে যাত্রী পাওয়া গিয়েছিল মাত্র দু’বার। তাই সেই কপ্টার কলকাতা থেকে তুলে নিয়ে এখন কেদারবদ্রী-তে চালানো হচ্ছে। তারও আগে কলকাতা থেকে দু’বার কপ্টার পরিষেবা চালাতে গিয়ে চরম ব্যর্থ কার্ট-এয়ার নামে আর এক সংস্থাও। হাতে গোনা কয়েক জন যাত্রী হয়েছিল কপ্টারে। তাদের কপ্টারও এখন অন্যত্র উড়ছে।