হায় বাঙালি, তোমার দিন গিয়াছে!
এমন এক তিক্ত আফসোস নিয়ে বছরটার দিকে ফিরে তাকালে হয়তো খুব বেমানান হতো না। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তা পারা গেল না। কারণ বাঙালি তো এ বছরেই রসগোল্লা পেয়েছে!
রসে টইটম্বুর শুভ্র গোলাকৃতি দুগ্ধজাত এই বস্তুটির সঙ্গে বাঙালির সখ্য বহু যুগের। বিবিধ প্রাপ্তির ভাণ্ডারেও রসগোল্লা তার বড় চেনা। তাই তাকে ‘আমার’ বলে আঁকড়ে ধরেছিল তারা। ‘কলিঙ্গ যুদ্ধে’ জিতে জিআই তালিকায় নাম তুলে অবশেষে সেই রসগোল্লা বাঙালির ‘মান’ রাখল।
কী দুর্দশাই হতো তা না হলে! কারণ বছরশেষে বাঙালির হিসেবের খাতায় সত্যিই এ বার রসগোল্লার ছড়াছড়ি। শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি মায় রাজনীতি— কোথাও তেমন কোনও উল্লেখযোগ্য সাফল্যের উদ্ভাস নেই। নেই কোনও সম্ভাবনাময় মুখচ্ছবি। যা আছে, তা নিছক পুরনো চাল ভাতে বাড়ানোর চেষ্টা। চারদিকে আরও যা যা ঘটেছে, তার অনেক কিছুই এড়ানো গেলে বছরটা কিছুটা স্বস্তির শ্বাস নিতে পারত।
কিন্তু হল কই! আসলে দূষণ-যুদ্ধে বাঙালি বরাবরই হেরে যাওয়ার দলে। সমাজ, সংস্কৃতি, রাজনীতি, পরিবেশ— সর্বত্র দূষণ পুষে রাখতে আমরা স্বচ্ছন্দ। শব্দ-দূষণ, বায়ু-দূষণ তো দূরস্থান, বাঙালি কি পারল পারস্পরিক অবিশ্বাসের বিষ থেকে নিজেদের বাঁচাতে? ধর্মের নামে গুজব ছড়িয়ে আগুন জ্বালানো রুখতে? বড় প্রমাণ জুলাই মাসের বসিরহাট-কাণ্ড। এ ধরনের প্রবণতা বাংলায় ছিল না।
যেমন ছিল না ‘রাম-রহিমের রাজনীতি’। রামনবমীর সশস্ত্র মিছিল ঘিরে এ বার রাজ্য জুড়ে যে উত্তেজনা তৈরি হল, আগে কখনও তেমন দেখা যায়নি। শাসককেও পাল্টা বলতে হয়নি, তাঁরা সংখ্যালঘু ‘তোষণ’ করবেন। এ সব যদি কোনও ইঙ্গিত হয়, তা হলে ২০১৭ বাংলাকে হতাশ করেছে। দেশের অন্য অনেক জায়গায় যা হয়, বাংলায় তা হয় না— সেই গর্ব নস্যাৎ করার আয়োজন কি তা হলে সম্পূর্ণ? চলে যাওয়া বছর আমাদের এই ভয়ঙ্কর প্রশ্নের মুখে দাঁড় করিয়ে গেল।
দার্জিলিঙের পাহাড়ে অশান্তি অবাঞ্ছিত হলেও অভিনব নয়। অতীতেও সেখানে এমন আগুন জ্বলেছে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পরে তাঁর সক্রিয়তায় পরিস্থিতি বদলেছিল। ভারসাম্যের খেলায় আবার তা অগ্নিগর্ভ হল গত জুন মাস থেকে। বিমল গুরুঙ্গের চেয়ারে বিনয় তামাঙ্গকে বসিয়ে পরিস্থিতি আপাত ভাবে শান্ত করা হলেও ভারসাম্যের খেলাটি এখনও নিরন্তর চলছে। বাঙালির চেনা দার্জিলিং বর্ষশেষেও তাই পুরোপুরি ছন্দে ফিরল না। চাপ রয়েই গিয়েছে।
তৃণমূলের বঙ্গে এ বছরের আরও দুই বিড়ম্বনা মশা এবং মুকুল। দুজনকে নিয়েই নানা যন্ত্রণা। অথচ প্রকাশ্যে তা স্বীকার করার নয়! ডেঙ্গির প্রকোপ যতই বাড়ুক, মৃত্যুর সংখ্যা কমিয়ে দেখানোর তাগিদে বিতর্ক সরকারের পিছু ছাড়ল না।
আর বিজেপি-তে ঢুকে মুকুল রায় এখন অনিয়ন্ত্রিত ক্ষেপণাস্ত্র। তৃণমূলে এখনও পর্যন্ত সে ভাবে ভাঙন ধরাতে না পারলেও আপাতত পুরনো দলের গায়ে কাদা ছিটিয়ে তাদের ব্যতিব্যস্ত করে রেখে তিনি বছরশেষে টিকে গেলেন খবরে।
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বছরভর খবরে থাকেন, এ আর নতুন কী! তবে তাঁর স্বপ্নের প্রকল্প ‘কন্যাশ্রী’ রাষ্ট্রপুঞ্জের মঞ্চে সেরা সম্মান জেতায় বাঙালি অন্তত একটু শ্লাঘাবোধ করুক। পুরস্কার নিতে জুন মাসে নেদারল্যান্ডসের দ্য হেগ-এ হাজির ছিলেন মমতা। ৬২টি দেশের ৫৫২টি প্রকল্পকে হারিয়ে তাঁর প্রকল্প জয়ী হয়। বাঙালির স্বভাবজাত রাজনীতি দূরে সরিয়ে এটা বছরের প্রাপ্তির তালিকায় স্থান পেতেই পারে।
কলকাতায় অনূর্ধ্ব ১৭ বিশ্বকাপ ফুটবলের আয়োজনও এ বছরের আর এক প্রাপ্তি। এই মাপের আন্তর্জাতিক ফুটবলের আসর এখানে এটাই প্রথম। ফিফা তো বটেই, দেশ-বিদেশের অতিথিদের প্রশংসা পেয়েছে নবসাজে সজ্জিত যুবভারতী ক্রীড়াঙ্গন এবং যাবতীয় সাংগঠনিক বন্দোবস্ত। সেই আলোও পড়েছে মমতার মুখে।
প্রসঙ্গত উল্লেখ থাক রহিম আলি, অভিজিৎ সরকার ও জিতেন্দ্র সিংহের। যুব বিশ্বকাপে ভারত হেরে মুখ লুকোলেও দলে স্থান পেয়েছিলেন ওই তিন বঙ্গসন্তান।
মহিলা ক্রিকেটের বিশ্বকাপও জিততে পারেনি ভারত। ফাইনালে মাত্র ৯ রানে পরাজয়। তবু ২৩ রানে ৩ উইকেট নিয়ে দেশের নজর কেড়েছেন বঙ্গতনয়া ঝুলন গোস্বামী। ২০১৭ তাঁরও কৃতিত্বের বছর।
উইকেটরক্ষক হিসেবে ঋদ্ধিমান সাহা ইতিমধ্যেই এক আলোচিত নাম। এই বছর আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে দু’টি শতরান তাঁর ঝুলিতে। বাংলাদেশের বিরুদ্ধে অপরাজিত ১০৬ এবং অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে ২৩৩ বলে ১১৭। ২০১৮–তে তিনি নিজেকে আরও বেশি চেনানোর সুযোগ পাবেন কি না, বলবে ভবিষ্যৎ।
সাহিত্য, সংস্কৃতির জগতে খরা চলছেই। চলচ্চিত্রেও চর্বিতচর্বণ। ঘুরেফিরে একই মুখ দেখা!
বিজ্ঞান সাধনায় বঙ্গমেধার স্বীকৃতি তুলনায় একটু বেশি। বিজ্ঞান চর্চায় দেশের সর্বোচ্চ সম্মান শান্তিস্বরূপ ভাটনগর পুরস্কার অর্জন করেছেন দুই বাঙালি— ধাতব বিজ্ঞান গবেষক অলক পাল এবং ক্যানসার গবেষক সঞ্জীব দাস। ইনফোসিস পুরস্কারে সম্মানিত সংখ্যাতত্ত্বের গবেষক ঋতব্রত মুন্সি এবং আইএসআই-এর ডিরেক্টর সঙ্ঘমিত্রা বন্দ্যোপাধ্যায়। মহাকাশ গবেষণায় বিশেষ কৃতিত্বের স্বাক্ষর রেখেছেন ইসরোর বিজ্ঞানী মৌমিতা দত্ত। এঁদের বেশির ভাগই এই রাজ্যে থাকেন না। তবু বাঙালি প্রবাসেও ‘বাঙালি’!
মৃত্যু অনিবার্য। পরিণত বয়সে চলে যাওয়া আরও স্বাভাবিক। তথাপি কিছু শূন্যতা আক্ষরিক অর্থেই অপূরণীয়। রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশনের প্রেসিডেন্ট স্বামী আত্মস্থানন্দ তেমন এক ব্যক্তিত্ব। গত জুনে ৯৮ বছর বয়সে প্রয়াত হয়েছেন কর্মযোগী এই সন্ন্যাসী।
মৃত্যুতে ফের প্রাসঙ্গিক হলেন দীর্ঘদিন লোকচক্ষের অন্তরালে চলে যাওয়া প্রিয়রঞ্জন দাশমুন্সি। বর্ণময় এই কংগ্রেস নেতা অসুস্থ হয়ে প্রায় জীবন্মৃত ছিলেন ন’টি বছর। মৃত্যুতে আবার তিনি সকলের মধ্যে জাগিয়ে গেলেন পুরনো স্মৃতি।
তবে সময় বহমান। নতুন বছরের দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে পিছনের টানে থামা চলে না। বরং এগিয়ে যাওয়ার শপথ নিতে হয়। বলতে হয়, এ বছরটা ‘মিষ্টি’ না হলেও আগামী বছর প্রাপ্তির ভাঁড়ার ভরিয়ে দেব। আশা করতে দোষ কী? সেখানে তো আর জিএসটি নেই!
অতএব আসুন, সবাই মিলে রসগোল্লা খেতে খেতেই ২০১৮-কে স্বাগত জানানো যাক।