Mahananda

নষ্ট নদীর কাহিনি মহানন্দা, তিস্তায়

সরকার আছে। আইন আছে। তবু কেউ নেই প্রকৃতি, পরিবেশের। মানুষের। বিষ জল, স্থল, বাতাসে।পাহাড় থেকে নামার পরে সমতলে সেবক থেকে জলপাইগুড়ি হয়ে মেখলিগঞ্জ পর্যন্ত এলাকায় তিস্তায় জল কমেছে ৫৫ শতাংশ।

Advertisement

অনির্বাণ রায়

জলপাইগুড়ি শেষ আপডেট: ১৪ ডিসেম্বর ২০২০ ০৪:৩৪
Share:

দূষণের কবলে মহানন্দা। নিজস্ব চিত্র

সুইৎজ়ারল্যান্ডের বিশেষজ্ঞ দলটি ঘুরে দেখছিল গোটা শিলিগুড়ি শহর। দেখছিল, হিমালয়ের ঠিক পাদদেশে থাকা শহরটির বাতাস কতটা দূষিত, জল কতটা নষ্ট। হিলকার্ট রোড ধরে এগোতে এগোতে মহানন্দা সেতুর কাছে এসে থেমে যায় তাঁদের গাড়ি। প্রথমে নদীর ছবি তোলেন তাঁরা। তার পরে নিজেদের মধ্যে আলোচনা করেন। কী বলছিলেন তাঁরা? সঙ্গী দোভাষী বলেন, “ওঁরা বলছেন, এমন দূষিত নদী আগে দেখেননি!”

Advertisement

এটা বেশ কয়েক বছর আগের কথা। তার পর থেকে অনেক জল গড়িয়েছে মহানন্দা দিয়ে। কিন্তু ছবি কি বদলেছে? এই প্রসঙ্গ উঠলে প্রশাসন থেকে স্থানীয় মানুষ দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে একটাই শব্দ বলেন, ‘না।’

অথচ এমনটা হওয়ার কথা ছিল না। নদী বাঁচাতে পরিকল্পনা ছিল। এক সময়ে মহানন্দাকে গঙ্গা অ্যাকশন প্ল্যানে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল। তৈরি হয়েছিল মহানন্দা অ্যাকশন প্ল্যানও। তাতে প্রথম ধাপে ৫৪ কোটি টাকা বরাদ্দও হয়েছিল। শিলিগুড়ির নর্দমার জল পরিশোধন করে নদীতে ফেলা হবে বলে ঠিক হয়েছিল। এতে দূষণমুক্ত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে নদীর জলধারণের ক্ষমতাও বাড়ত। শহরের আরও দু’টি নদী ফুলেশ্বরী এবং জোড়াপানিরও সংস্কারের কথা ছিল ওই প্রকল্পে। এই নিয়ে এসজেডিএ কাজও শুরু করে। এবং শুরুতেই দুর্নীতির অভিযোগ ওঠে। কাজ না করেই পাওনা মিটিয়ে দেওয়ার অভিযোগে একাধিক মামলা হয়। সে সব মামলা এখন ঝুলে রয়েছে। সংস্কারের কাজও বন্ধ। গঙ্গা অ্যাকশন প্ল্যান থেকে বাদ পড়েছে মহানন্দা। এসজেডিএ-র বর্তমান চেয়ারম্যান বিজয়চন্দ্র বর্মণের কথায়, “আগামী বোর্ড মিটিংয়ে মহানন্দা অ্যাকশন প্ল্যান নিয়ে আলোচনার কথা রয়েছে।”

Advertisement

মহানন্দা যদি এক বোন হয়, তা হলে আর এক বোন তিস্তা। দুই নদীই নেমেছে হিমালয় থেকে, দৈর্ঘ্যও প্রায় এক। উত্তরবঙ্গের কৃষি বলয়ের সিংহভাগ অংশকে এক সময়ে জল দিত তিস্তা। তাই ‘তিস্তাপারের বৃত্তান্ত’ মণ্ডলঘাট-বোয়ালমারি-বানারহাট-গয়েরকাটার চার বাসিন্দাকে উৎসর্গ করে দেবেশ রায় লিখেছিলেন, “এই বৃত্তান্ত তারা কোনও দিনই পড়বে না, কিন্তু তিস্তাপারে জীবনের পর জীবন বাঁচবে।” এখন মণ্ডলঘাটের বাসিন্দা, এ প্রজন্মের কৃষক বাবলু রায় বলছেন, “তিস্তায় জলই নেই, শুখার সময়ে তো জলই পাই না।” তিস্তার জল নিয়ে যখন দু’দেশের টানাপড়েন চলছে, তখনই কেন্দ্রীয় জল আয়োগের তথ্য জানাচ্ছে, পাহাড় থেকে নামার পরে সমতলে সেবক থেকে জলপাইগুড়ি হয়ে মেখলিগঞ্জ পর্যন্ত এলাকায় তিস্তায় জল কমেছে ৫৫ শতাংশ।

শুখা মরসুমে এমনই দশা তিস্তার । নিজস্ব চিত্র

পরিবেশকর্মীদের দাবি, সিকিম এবং কালিম্পংয়ে বেশ কিছু জলবিদ্যুৎ প্রকল্প হয়েছে। সিকিমে একের পর এক পানীয় জল প্রকল্প গড়ে উঠেছে তিস্তায়। নদী থেকে পাম্প করে জল নিয়ে নেওয়া হচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে। সঙ্গে দোসর অবৈধ খাদান। জলপাইগুড়ির রংধামালি, পাহাড়পুরের বাসিন্দাদের প্রতি ভোরে ঘুম ভাঙে বড় ট্রাকের ভারী চাকার শব্দে। অথচ নদী বাঁচাতে সরকারি খাদানের কোনও অনুমতি নেই তিস্তায়। জলপাইগুড়ির অতিরিক্ত জেলাশাসক (ভূমি) রঞ্জন চক্রবর্তী বলেন, ‘‘অবৈধ খাদান রুখতে সব ব্লকে নিয়মিত অভিযান চলে। তার পরেও যদি নির্দিষ্ট কোনও অভিযোগ আসে, পুলিশকে সঙ্গে নিয়ে অভিযান হয়।’’

এই ভাবেই এক দিকে শুকিয়ে যাচ্ছে তিস্তা, অন্য দিকে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে মহানন্দা। উত্তরবঙ্গের দুই জীবনরেখা। জল নেই বলে বন্ধ হয়ে রয়েছে তিস্তা সেচ প্রকল্পের সম্প্রসারণও। সেচ দফতরের এক আধিকারিকের কথায়, “শুখা মরসুমে পাড়ের জমিগুলিকে চাষের জল দিতেই তো প্রকল্প হয়েছিল। এখন শুখাতে তিস্তায় জল থাকে না। প্রকল্প আর এগোবে কী করে?”

দেবেশবাবুর বাঘারু সেই তিস্তা সেচ প্রকল্পের বাঁধকে প্রত্যাখ্যান করে তিস্তাপার ছেড়ে হাঁটা দিয়েছিল। এখন শুকিয়ে আসা তিস্তার পাড় ছেড়ে চাষিরা কেউ কেউ বাঘারুর মতোই অন্য জমি খুঁজছেন।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement