এমআরআই-এর জন্য নিয়ে যাওয়া হচ্ছে রজত মজুমদারকে। বুধবার এনআরএস হাসপাতালে।—নিজস্ব চিত্র।
তিনি নাকি অসুস্থ। আইসিসিইউ-তে ভর্তি।
কীসের অসুখ? কোথায় ব্যামো? সারাদিন হন্যে হয়ে খুঁজছেন চিকিৎসকেরা। মস্তিষ্কের এমআরআই অবধি হয়ে গেল। ফল তবু শূন্যি।
আইসিসিইউ থেকে কিন্তু এর পরেও বের করা হয়নি সারদা মামলায় ধৃত তৃণমূল নেতা, প্রাক্তন ডিজি রজত মজুমদারকে। আজ, বৃহস্পতিবার মেডিক্যাল বোর্ডের সদস্যরা তাঁকে পরীক্ষা করবেন। তার আগে কোনও ঝুঁকি নেওয়া হবে না বলে জানিয়ে দিয়েছেন হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ।
কিন্তু যে ধরনের উপসর্গ থাকলে কোনও রোগীকে আইসিসিইউ-তে রাখা হয়, সে সব কিছুই না থাকা সত্ত্বেও রজতবাবুকে এই ভাবে সরকারি হাসপাতালের গুরুত্বপূর্ণ শয্যা দখল করে রেখে দেওয়া হয়েছে কেন?
প্রশাসনের অন্দরে অনেকেই বলছেন, এটা কোনও নতুন কথা নয়। নেতারা প্রয়োজন মতো রাজনৈতিক অসুস্থতায় ভুগেই থাকেন। গ্রেফতারের ঘোষণা হতেই ‘বুকে ব্যথা’ অতি পরিচিত ট্র্যাডিশন। ভিআইপি-রা পুলিশের জালে পড়লেই তাঁদের হাসপাতালে পাঠানোর একটা অলিখিত রেওয়াজ তাই আছেই। এসএসকেএমের উডবার্ন ওয়ার্ডের কোনও না কোনও কেবিন তাই বেশির ভাগ সময়ই এ জন্য ‘বরাদ্দ’ থাকে। অন্যান্য হাসপাতালেও কম-বেশি এমন রেওয়াজ আছে। নীলরতন সরকার হাসপাতালের আইসিসিইউ তাই ব্যতিক্রম নয়।
রজতবাবুকে পরীক্ষা করা কার্ডিওলজি বিভাগের এক চিকিৎসকই এ দিন স্বীকার করেন, ওঁর রিপোর্ট সব স্বাভাবিকই এসেছে। “এ অবস্থায় রোগীকে ছেড়ে দেওয়াটাই দস্তুর। কিন্তু উনি নিজে বারবার বলছিলেন, বুকে অসহ্য ব্যথা। শ্বাসকষ্ট হচ্ছে। তাই মিলিত ভাবে সিদ্ধান্ত হয় ভর্তি রাখা হবে।” বুকে ব্যথা-শ্বাসকষ্টের উৎস যদিও খুঁজে বের করতে পারেননি চিকিৎসকরা। হাসপাতাল সূত্রেরই খবর, মঙ্গলবার দু’-দু’বার ইসিজি রিপোর্ট স্বাভাবিক এসেছে। নাড়ির গতিও তেমন অস্বাভাবিক নয়। রক্ত পরীক্ষায় কিছু পাওয়া যায়নি। মেডিসিন বিভাগের ডাক্তাররাও পরীক্ষা করে কিছু পাননি। আজ মেডিক্যাল বোর্ড রজতবাবুকে দেখবে।
এ দিন সকালেই সাত সদস্যের বোর্ড তৈরি করেন হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। সেখানে চার জন কার্ডিওলজিস্ট, এক জন এন্ডোক্রিনোলজিস্ট, এক জন নিউরোলজিস্ট এবং এক জন মেডিসিন-এর চিকিৎসক রয়েছেন। বস্তুত এ দিন দুপুরেই বোর্ড রজতবাবুকে পরীক্ষা করবে বলে ঠিক ছিল। কিন্তু বিকেলে সুপার দেবাশিস গুহ জানান, “এমআরআই করানোর জন্য আজ অনেকক্ষণ উনি (রজতবাবু) ওয়ার্ডের বাইরে ছিলেন। তাই বোর্ডের সদস্যরা একত্রিত হয়ে ওঁকে দেখার সুযোগ পাননি। বৃহস্পতিবার সকালে পরীক্ষার পরে পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।” কিন্তু যেখানে সঙ্কটজনক রোগীদের হামেশাই আইসিসিইউ-তে জায়গা না পেয়ে ফিরে যেতে হয়, সেখানে রোগ খুঁজে না পেয়েও এক জনকে অবলীলায় শয্যার ব্যবস্থা করে দেওয়া হচ্ছে কী ভাবে? কর্তৃপক্ষ জানিয়েছেন, বিষয়টি সিবিআই-এর অধীনে রয়েছে। তাই ঝুঁকি নেওয়া হয়নি। তবে রজতবাবুর ভর্তিকে ঘিরে মঙ্গলবার সন্ধে থেকেই টানাপড়েনে রয়েছেন এনআরএসের ডাক্তাররা। রোগীর বয়ান আর বাস্তবের ফারাকটা তাঁদের চোখে পড়ছেই। ইমার্জেন্সির এক চিকিৎসকের কথায়, “উনি মুখে বলছিলেন বুকের বাঁ দিকে ব্যথা হচ্ছে। কিন্তু চেপে ধরছিলেন ডান দিকটা। বুকে ব্যথা হলে সাধারণ ভাবে কথা কিছুটা জড়িয়ে যায়। ওঁর সেটাও হয়নি।” প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অধীর চৌধুরী এ দিন তাই কটাক্ষ করে বলেন, “অসুখটা যে আসলে ঠিক কোথায়, সেটা সকলেই দেখছেন!” তবে রাজনীতির জগতে এমন দৃষ্টান্ত যে হেতু ভূরি ভূরি, তাই বিশেষ অবাক হচ্ছেন না কেউ।
ক’দিন আগে তাঁর বিতর্কিত মন্তব্য নিয়ে তোলপাড় শুরু হওয়ার পরে সংসদে হাজির থাকার ঝুঁকি নেননি তাপস পাল। তড়িঘড়ি মধ্য কলকাতার এক নার্সিংহোমে ভর্তি হয়ে গিয়েছিলেন। তাঁর অসুখটা যে ঠিক কী, সে নিয়ে তাঁর চিকিৎসক এবং ওই নার্সিংহোমের সিইও-র বক্তব্যে কোনও সামঞ্জস্য ছিল না। এক জন বলেছিলেন প্রবল জ্বর, অন্য জনের বক্তব্য ছিল পিঠে ব্যথা। কোনওটাই কি হাসপাতালে ভর্তি রেখে চিকিৎসা করার মতো? প্রশ্নের জবাবে দু’জনেই নীরব ছিলেন।
রাজ্যের পরিবহণমন্ত্রী মদন মিত্রের নার্সিংহোম-বাস সম্পর্কেও এই একই ধরনের অভিযোগ শোনা যায়। তাঁর নার্সিংহোমে ভর্তি হওয়ার সঙ্গত কারণ থাকলেও সেখান থেকে ছুটি পাওয়া নিয়ে রীতিমতো নাটক হয়। নার্সিংহোম সূত্রে খবর, মদনবাবু ছুটি নিতে অস্বীকার করছিলেন। কিন্তু ক’দিন পরে দলেরই এক নেতা কর্তৃপক্ষকে ফোন করে জানান, ভর্তি রাখার সঙ্গত কারণ না-থাকা সত্ত্বেও যদি মদনবাবুকে রেখে দেওয়া হয়, তা হলে সিবিআই-এর কোপে পড়তে পারেন তাঁরা। এর পরে নার্সিংহোম কর্তৃপক্ষ আর কোনও ঝুঁকি নেননি।
রজতের বেলা কী হয়, দেখার।