অবশেষে তিনি মুখ খুললেন। বর্ধমানের খাগড়াগড়ে বিস্ফোরণ এবং তার সঙ্গে আন্তর্জাতিক জঙ্গি সংগঠনের যোগসূত্র মেলার পরে টানা পনেরো দিন মুখে কুলুপ এঁটে ছিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। রাজ্যের স্বরাষ্ট্র দফতরের ভার তাঁর কাঁধে থাকা সত্ত্বেও। মাঝে, ঠিক এক সপ্তাহ আগে অবশ্য খাগড়াগড়ে এনআইএ তদন্তের প্রসঙ্গ সরাসরি উল্লেখ না-করেই রাজ্যের এক্তিয়ারে হস্তক্ষেপ করার জন্য কেন্দ্রকে দুষেছিলেন তিনি। শুক্রবার তৃণমূল ভবনে দোষারোপের সেই চড়া সুর কিন্তু ছিল না। মমতার মন্তব্য, “এনআইএ-র বিরোধিতা আমি করিনি। কিন্তু রাজ্যকে তো এক বার জানাতে হবে ভাই!”
বর্ধমান কাণ্ড নিয়ে এনআইএ-র তদন্ত যত এগোচ্ছে ততই দু’টি জিনিস স্পষ্ট হচ্ছে। এক, গোটা জঙ্গি জালের সঙ্গে শাসক দলের প্রচ্ছন্ন যোগাযোগ। দুই, রাজ্য পুলিশ ও গোয়েন্দাদের গাফিলতি। যে দু’টি ঘটনা পরস্পরের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত বলেই প্রশাসনের একটা বড় অংশের মত। “রাজ্য পুলিশ ভাল কাজ করেছে” বলে আজ নিজের দফতরের পাশেই দাঁড়ান মুখ্যমন্ত্রী।
দল ও প্রশাসনের অন্দরে এনআইএ তদন্ত নিয়ে তীব্র উষ্মা প্রকাশের পরে মমতা এ দিন কেন সুর নরম করলেন, তা নিয়ে জল্পনা শুরু হয়েছে। মুখ্যমন্ত্রী অবশ্য দাবি করেছেন, “আমি ফেসবুকে এনআইএ সম্পর্কে কোনও মন্তব্য করিনি। সংবাদমাধ্যম আমার বক্তব্য বিকৃত করেছে।” যে পদ্ধতিতে কেন্দ্র এনআইএ-কে তদন্তভার দিয়েছে, তা তাঁর পছন্দ হয়নি জানিয়ে মমতা বলেন, “আমাদের সঙ্গে কোনও আলোচনা না করে, ওঁরা অপমান করে যাবেন, তা হয় না।”
নবান্নের একটি সূত্র কিন্তু বলছে, এনআইএ-কে তদন্তভার দেওয়া নিয়ে সরকারি ভাবে এবং অন্য সূত্রে রাজ্য সরকারের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রেখেছিল কেন্দ্র। গত ৮ তারিখ দুপুরে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের যুগ্মসচিব রাকেশ সিংহ রাজ্যের মুখ্যসচিব সঞ্জয় মিত্রকে একটি ফ্যাক্স বার্তা পাঠান। তাতে বলা হয়, সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত খবর থেকে তাঁরা খাগড়াগড় বিস্ফোরণের কথা জেনেছেন। এটাও জেনেছেন যে, এই জঙ্গি জাল দেশের অন্যত্র, এমনকী ভিন দেশেও ছড়িয়ে। এই পরিস্থিতিতে এনআইএ আইনের ৬(১) ও ৬(২) ধারায় রাজ্যের কাছ থেকে রিপোর্ট তলব করা হচ্ছে। এই দুই ধারায় বলা হয়েছে, এনআইএ আইনে বিধিবদ্ধ কোনও ঘটনার খবর পেলে সংশ্লিষ্ট থানার ইনচার্জ তৎক্ষণাৎ তা রাজ্য সরকারকে জানাবেন। সেই রিপোর্ট পাওয়ার পরে রাজ্য সরকার যত দ্রুত সম্ভব কেন্দ্রকে পাঠিয়ে দেবে।
সে দিনই সন্ধ্যায় রিপোর্টের খসড়া তৈরি করে রাজ্য। তাতে ঘটনার বিবরণ দিয়ে বলা হয়, সিআইডি গোটা বিষয়টির তদন্ত করছে। নবান্ন সূত্র বলছে, এই খসড়া দেখে গোড়ায় আপত্তি জানিয়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রী। কিন্তু প্রশাসনের শীর্ষ কর্তারা তাঁকে বলেন, রিপোর্টে কোথাও এনআইএ তদন্তে সায় দেওয়া নেই। তা ছাড়া, ২০০৮ সালে মমতার উপস্থিতিতেই যে সংসদে এনআইএ আইন পাশ হয়েছিল, তাও তাঁকে মনে করিয়ে দেন তাঁরা।
পরের দিন, ৯ অক্টোবর রিপোর্ট পাঠানো হয় দিল্লিতে। সে দিন রাতেই এনআইএ-কে তদন্ত করার নির্দেশ দেয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক। এনআইএ আইনের ৬(৩) ধারায় বলা হয়েছে রাজ্য সরকারের রিপোর্ট এবং অন্য সূত্র থেকে তথ্য পাওয়ার পরে কেন্দ্র ঠিক করবে ওই ঘটনায় এনআইএ-র তদন্ত করার দরকার আছে কিনা। এ ব্যাপারে রাজ্যের সঙ্গে পরামর্শ করার কোনও কথা নেই। নবান্ন সূত্র বলছে, এনআইএ তদন্ত নিয়ে কেন্দ্র লিখিতপড়িত ভাবে রাজ্যের পরামর্শ চায়নি ঠিকই, কিন্তু বিষয়টি নিয়ে রাজ্য প্রশাসনের শীর্ষ কর্তাদের সঙ্গে একাধিক বার কথা হয়েছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের পদাধিকারীদের। কেন এই তদন্তে এনআইএ-কে দরকার, তা রাজ্য সরকারকে বারবার বুঝিয়েছেন তাঁরা।
বস্তুত, রাজ্য পুলিশকে দিয়ে এই তদন্ত যে হতো না, সেটা কেন্দ্রীয় সংস্থা আসার পরে বারবার প্রমাণিত হয়েছে। মঙ্গলকোটের শিমুলিয়া মাদ্রাসায় প্রচুর নথি ছিল। বধর্মান জেলা পুলিশ কিংবা সিআইডি তার নাগাল পায়নি। বর্ধমান শহরের বাদশাহি রোডে রেজাউল শেখের বাড়িতে তল্লাশি চালিয়েও শৌচাগারে লুকিয়ে রাখা আইইডি-র খোঁজ পায়নি তারা। বৃহস্পতিবার এনএসজি সেগুলি উদ্ধার করেছে। বাংলাদেশের জঙ্গি গোষ্ঠীর যে সব নেতা এই বোমা তৈরির কাজ করছিল, তাদের এক জনকেও ধরতে পারেনি পুলিশ। উল্টে তাদের পালানোর সুযোগ করে দিয়েছে বলেই অভিযোগ।
এ সব সত্ত্বেও মুখ্যমন্ত্রী এ দিন পুলিশের কাজের প্রশংসা করেছেন। কেন? তাঁর ব্যাখ্যা, “যে দিন বিস্ফোরণ হয় সে দিন অষ্টমী পুজো ছিল। সামনে ঈদ। তার মধ্যে আমাদের পুলিশ, অফিসাররা ভাল কাজ করেছে। আমাদের পুলিশ যে ভাল কাজ করছে, তা এনআইএ-ও বলেছে।”
যদিও এনআইএ-র সার্টিফিকেট নিয়ে প্রশাসনের বড় অংশেরই বক্তব্য, কোথাও তদন্ত চালাতে গেলে প্রতি পদে যে হেতু স্থানীয় পুলিশের সাহায্য প্রয়োজন হয়, সে হেতু প্রকাশ্য সংঘাতে যেতে চায় না তারা। একান্ত আলাপ-আলোচনায় কিন্তু রাজ্য পুলিশের তদন্ত পদ্ধতি নিয়ে বিস্ময়ই প্রকাশ করেছেন এনআইএ গোয়েন্দারা।
অনুপ্রবেশ নিয়ে বিরোধীদের সুর ক্রমেই চড়ছে এবং অনুপ্রবেশকারীদের আশ্রয় দেওয়ার ক্ষেত্রে তাঁর দলের লোকেদের নামই উঠে আসছে দেখে মুখ্যমন্ত্রী এ দিন পাল্টা আক্রমণাত্মক হন। তাঁর বক্তব্য, “অনুপ্রবেশ বন্ধ করা কেন্দ্রের কাজ। এটা আমাদের দেখার বিষয় নয়। কিন্তু কেন্দ্র যদি রাজ্যকে বলে অ্যাকশন নাও, তবে আমরাই বিষয়টি দেখতে পারি।” এ প্রসঙ্গে বিএসএফ-এর ডিজি দেবেন্দ্র পাঠক বলেন, “তদন্ত চলছে। দেখাই যাক না, এই ঘটনায় কারা দায়ী। কাদের কর্তব্যে গাফিলতি হয়েছে। তদন্তে তো সব বেরিয়ে আসবে।” বর্ধমান কাণ্ডে দল ও প্রশাসন দু’টোই কাঠগড়ায় উঠে যাওয়ায় তিনি যে চাপে রয়েছেন, সেটা অবশ্য এ দিনের সাংবাদিক সম্মেলনে মমতার হাবভাবই বুঝিয়ে দিয়েছে। ভোটব্যাঙ্ক রক্ষার চেষ্টার তাঁর মন্তব্য, “এই ধরনের ঘটনা গুরুত্ব দিয়ে দেখা উচিত। কারণ উগ্রপন্থীদের কোনও জাত, ধর্ম হয় না। কেউ কোনও অপরাধ করলে একটা গোটা সম্প্রদায় বা জাতিকে দায়ী করা ঠিক নয়।”
বিজেপি কিন্তু তৃণমূলকে এতটুকু জমি ছাড়তে রাজি নয়। দলের কেন্দ্রীয় সম্পাদক তথা এ রাজ্যে দলের পর্যবেক্ষক সিদ্ধার্থনাথ সিংহ এ দিন বলেন, “বর্ধমানের এসপি-কে লোকসভা ভোটের আগে নির্বাচন কমিশন সরিয়ে দিয়েছিল। ভোটের পরে মুখ্যমন্ত্রী তাঁকে পুনর্বহাল করেন। তিনিই গাড়ি করে আইইডি নিয়ে গিয়ে ধ্বংস করেছেন।” বিজেপি-র রাজ্য সভাপতি রাহুল সিংহের বক্তব্য, “রাজ্য পুলিশ এবং সিআইডি যদি সব কিছু দেখেও না দেখে থাকে, তা হলে তা অপরাধ। আর যদি তারা তা খুঁজেই না পেয়ে থাকে, তা হলে তাদের অপদার্থতা প্রমাণিত হয়।”