মঙ্গলবার এসএসকেএম হাসপাতালে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। ছবি: পিটিআই
কপ্টার-দুর্বিপাকে আহত হয়ে মঙ্গলবার রাত থেকে ঘরবন্দি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। অথচ, বুধবার সন্ধ্যা পর্যন্ত বিরোধী জোটে তাঁর ‘বন্ধু’ কোনও নেতানেত্রীর তরফে প্রকাশ্যে তাঁর আরোগ্যকামনা বা দ্রুত সুস্থতার বার্তা দেখা গেল না। যা ইদানীংকালের রাজনীতিতে খানিকটা বিরলই বটে। এই ধরনের ঘটনায় টুইটারে দ্রুত আরোগ্যকামনার বার্তা চলে আসে। যেমন শুভেচ্ছাবার্তা যায় বিভিন্ন নেতানেত্রীর জন্মদিনেও। অনেকে ব্যক্তিগত ভাবে ফোন করে আরোগ্যকামনা করেন। কিন্তু পাশাপাশিই সমাজমাধ্যমে পোস্ট করে সর্বসমক্ষেও তা জানান। সেটি মূলত ‘রাজনৈতিক বার্তা’ দেওয়ার উদ্দেশ্যেই। কিন্তু এ বার মমতা আহত হওয়ার পরে তেমনকিছু দেখা যায়নি।
মঙ্গলবার দুপুরে প্রাকৃতিক দুর্যোগে কপ্টার-দুর্বিপাকে আহত হন মুখ্যমন্ত্রী মমতা। তাঁর কপ্টার জরুরি অবতরণ করে শিলিগুড়ির অদূরে সেবক এয়ারবেসে। কপ্টার থেকে নামতে গিয়ে পায়ে ও কোমরে চোট পান মমতা। কলকাতায় ফেরার পর তাঁকে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল এসএসকেএম হাসপাতালে। এমআরআই ইত্যাদি করানোর পর দেখা যায়, তাঁর পায়ের লিগামেন্টে চোট লেগেছে। আঘাত লেগেছে কোমরেও। বস্তুত, চিকিৎসকেরা তাঁকে ভর্তি করে নিতেই চেয়েছিলেন। কিন্তু মমতা রাতেই কালীঘাটের বাড়িতে ফিরে যান। বুধবার পর্যন্ত তিনি বাড়িতেই বিশ্রামে রয়েছেন।
চিকিৎসকেরা জানিয়েছেন, মুখ্যমন্ত্রীর চোট তেমন গুরুতর নয়। মঙ্গলবার এসএসকেএমের ডিরেক্টর মণিময় বন্দ্যোপাধ্যায় জানান, মুখ্যমন্ত্রীকে হাসপাতালে থেকে চিকিৎসা করানোর পরামর্শ দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু তিনি থাকতে চাননি। বাড়িতেই চিকিৎসকদের পরামর্শ মতো চিকিৎসা চলছে মুখ্যমন্ত্রীর। সূত্রের খবর, মুখ্যমন্ত্রীকে হাঁটুতে পরার জন্য ‘নি-ক্যাপ’ দেওয়া হয়েছে। তাঁকে নিয়ন্ত্রিত হাঁটাচলার পরামর্শও দেওয়া হয়েছে।
মমতা আহত হওয়ার ঘটনায় দলের নেতানেত্রীরা উদ্বিগ্ন। ঘটনাপ্রবাহ বলছে, অনেকটা বরাতজোরেই বড় দুর্ঘটনার হাত থেকে রক্ষা পেয়েছে মুখ্যমন্ত্রীর কপ্টার। রাজ্যের বিরোধী নেতারা দুর্ঘটনা নিয়ে নানা ‘প্রশ্ন’ তুললেও সকলেই মুখ্যমন্ত্রীর দ্রুত আরোগ্যকামনা করেছেন। এই ধরনের ঘটনা ঘটলে রাজনৈতিক বৈরিতা ভুলে প্রধানমন্ত্রী বা গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্রীয় মন্ত্রীরা টুইট করে সংশ্লিষ্ট নেতা বা নেত্রীর আরোগ্যকামনা করেন। এ ক্ষেত্রে নরেন্দ্র মোদী বা অমিত শাহ তেমন কিছু করেননি। ভাবা গিয়েছিল, সদ্য পটনায় বিরোধী জোটের বৈঠকের পর যে ‘বোঝাপড়া’ তৈরির প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে, তাতে ‘বন্ধু’ দলগুলির নেতা বা নেত্রীদের তরফে আরোগ্যকামনার প্রকাশ্য বার্তা আসবে। কিন্তু তেমনকিছুও ঘটেনি।
কেউ ব্যক্তিগত ভাবে মমতাকে ফোন করেছিলেন কি না, তা অবশ্য জানা যায়নি। তবে এসব ক্ষেত্রে তেমনকিছু হলে সাধারণত কোনও একটি পক্ষের তরফে তা প্রকাশ্যে জানিয়ে দেওয়া হয়। যেমন মঙ্গলবার রাজ্যপাল সি ভি আনন্দ বোসের ফোনের কথা জানাজানি হয়েছিল। কিন্তু আর কারও ফোনের কথা কোনও পক্ষ থেকেই জানানো হয়নি।
টুইট তো দূরের কথা, কেন্দ্রীয় সরকারের পক্ষে প্রধানমন্ত্রী মোদী বা কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহের তরফে বাংলার মুখ্যমন্ত্রীর কাছে কোনও ফোন আসেনি বলেই দাবি তৃণমূলের। দলের অন্যতম মুখপাত্র কুণাল ঘোষ বিষয়টিকে ‘অসৌজন্য’ বলে দাবি করেছেন। আনন্দবাজার অনলাইনকে তিনি বুধবার বলেন, ‘‘বড় দুর্ঘটনার হাত থেকে রক্ষা পেয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী। আমাদের দেশে হেলিকপ্টার বিপর্যয়ে চরম পরিণতির উদাহরণ অনেক। কিন্তু তা সত্বেও প্রধানমন্ত্রীর পক্ষ থেকে একটাও ফোন আসেনি। আসলে তিনি ভারতের নন, বিজেপির প্রধানমন্ত্রী।’’
তবে বিরোধী জোটের অন্যান্য দলের নেতাদের তরফে আরোগ্যকামনার প্রকাশ্য বার্তা না থাকা নিয়ে ততটা ‘আক্রমণাত্মক নন’ কুণাল। তিনি বলেন, ‘‘অনেকেই হয়তো ফোন করে নেত্রীর সঙ্গে কথা বলেছেন। শারীরিক খবরাখবর নিয়েছেন। সবটা তো আর জানা যায় না।’’ কিন্তু রাহুল গান্ধী থেকে নীতীশ কুমার, অরবিন্দ কেজরীওয়াল থেকে অখিলেশ যাদব— কেউই বুধবার বিকেল পর্যন্ত মমতার হেলিকপ্টার দুর্বিপাক বা আঘাত পাওয়া নিয়ে প্রকাশ্যে একটি শব্দও খরচ করেননি। না মৌখিক বার্তায়, না সমাজমাধ্যমে।
গত ২৩ জুন পটনার বৈঠকে মমতার সঙ্গে ছিলেন পিডিপি নেত্রী মেহবুবা মুফতি, শিবসেনা (বালাসাহেব) দলের প্রধান উদ্ধব ঠাকরে, এনসিপি নেতা শারদ পাওয়ার, সিপিএম সাধারণ সম্পাদক সীতারাম ইয়েচুরিরা। কিন্তু কেউই মঙ্গলবারের ঘটনা নিয়ে বুধবার পর্যন্ত কোনও টুইট করেননি। এমনিতেই জোটের ভবিষ্যৎ নিয়ে বিভিন্ন মহলে প্রশ্ন তৈরি হয়েছে। আগামী ১২ জুলাই সম্ভাব্য জোটের দ্বিতীয় বৈঠক হওয়ার কথা শিমলায়। তার আগে জোট নিয়ে অন্যতম উদ্যোগী মমতা আহত হওয়ার পর জোটসঙ্গীদের তরফে প্রকাশ্য বার্তার আশা করেছিলেন অনেকেই। কিন্তু এখনও পর্যন্ত তা হয়নি।
বিজেপির রাজ্য সভাপতি সুকান্ত মজুমদারের অবশ্য বক্তব্য, ‘‘আসলে কেউ বিশ্বাসই করছে না! এটা মুখ্যমন্ত্রী এবং বাংলার মানুষের কাছে অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক।’’ মঙ্গলবার মমতার চোট পাওয়ার খবর জানাজানির সময়ে সাংবাদিক বৈঠকে ছিলেন সুকান্ত। খবর পেয়েই তিনি বলেছিলেন, ‘‘ভোট এলেই কেন বার বার পায়ে আঘাত পান মুখ্যমন্ত্রী? বার বার পায়ে চোট মানেই শুভলক্ষণ নয়।’’ তবে মুখ্যমন্ত্রীর দ্রুত আরোগ্যকামনাও করেছিলেন তিনি। সঙ্গে কটাক্ষের সুরে বলেছিলেন, ‘‘জ্যোতিষের সঙ্গে ওঁর আলোচনা করা উচিত। কেন বার বার ভোটের আগে পায়ে চোট পাচ্ছেন এটা জানা দরকার।’’ বুধবার সুকান্ত বলেন, ‘‘বিরোধী যে জোটের কথা শোনা যাচ্ছে, সেটার মধ্যে ‘ধান্দা’ রয়েছে। একে ইংরেজিতে বলে ‘মিউচুয়াল বেনিফিশিয়াল রিলেশন।’ কিন্তু মুখ্যমন্ত্রী যদি আবার হুইলচেয়ার নিয়ে বের হন, তা হলে মনে রাখতে হবে, বিধানসভা নির্বাচনের মঞ্চসফল নাটকের টিকিট এ বার আর বিক্রি হবে না।’’ তবে পাশাপাশিই সুকান্ত জানাচ্ছেন, ফোন নম্বর জোগাড় করে তিনি মুখ্যমন্ত্রীকে এক বার ফোন করে তাঁর দ্রুত আরোগ্যকামনা করতে চান। বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী অবশ্য মঙ্গলবারই বলেছিলেন, ‘‘মুখ্যমন্ত্রী সুস্থ ভাবে ফিরে এসেছেন। রাজ্যবাসী হিসেবে এটা আমাদের জন্য সুখবর।’’
কটাক্ষের সুর সিপিএমের রাজ্য সম্পাদক নেতা মহম্মদ সেলিমের গলাতেও। মুখ্যমন্ত্রীর আরোগ্যকামনা করেও ২০২১ সালের বিধানসভা ভোটের আগে নন্দীগ্রামে মমতার চোট পাওয়ার প্রসঙ্গ টেনে আনেন তিনি। সেলিমের খোঁচা, ‘‘নির্বাচনের আগে এ রকম দুর্ঘটনা হলে আশঙ্কা হয়, আবার তিনি মাথায় ফেট্টি বেঁধে হুইলচেয়ারে বসে সিপিএমকে গাল দিয়ে প্রচার করবেন!’’ তবে তিনিও মুখ্যমন্ত্রী যাতে দ্রুত সেরে ওঠেন, সেই কামনা করেছেন। পাশাপাশিই বলেছেন, ‘‘মাটিতে পা রেখে চলতে শিখুন। নির্বাচনের আগে দুর্ঘটনা কেন হয়?’’