— ফাইল চিত্র।
শুধু দেড়টা বছর।
মার্কিন নেভি সিল কম্যান্ডোরা ওসামা বিন লাদেনকে হত্যা করেছিল ২০১১ সালের ২ মে। আর ২০১২-র ডিসেম্বরে মুক্তি পেয়েছিল সেই ঘটনা অবলম্বনে তৈরি হলিউডের ছবি ‘জিরো ডার্ক থার্টি’।
শুধু একটা বছর।
১৯৭২-এ গ্রেফতার হন চারু মজুমদার। কিছু দিনের মধ্যে হাজতেই মারা যান তিনি। তার পরই এক রকম দাঁড়ি পড়ে যায় সত্তরের নকশাল আন্দোলনে। আর ১৯৭৩-এ মুক্তি পায় মৃণাল সেনের ‘পদাতিক’। এক গেরিলা যোদ্ধার অজ্ঞাতবাসকে কেন্দ্র করে তৈরি ছবি।
সাড়ে তিন বছর পার।
কোথাও কিচ্ছু নেই। মাওবাদী নেতা কিষেণজি মারা যান ২০১১ সালের নভেম্বরে। ২০০৮-এর নভেম্বরে শুরু লালগড় আন্দোলনও মোটামুটি ওখানেই শেষ। কিন্তু আজও লালগড়ের পটভূমিকায় কোনও ছবি তৈরি হল না। আফসোস করছিলেন তখনকার লালগড়ে পুলিশি সন্ত্রাসবিরোধী জনসাধারণের কমিটির অন্যতম নেতা কিঙ্কর সিংহ। ‘‘আমাদের আন্দোলন গোটা ভারতে নজির তৈরি করেছিল। অথচ সেটা নিয়ে ছবি করার কথা কেউ ভাবলেন না। জঙ্গলমহল এ ক্ষেত্রেও বঞ্চিত,’’ আক্ষেপ কিঙ্করের। তাঁদের হতাশার অবশ্য আরও কারণ আছে। চলতি মাসেই মুক্তি পেতে চলেছে এমন দু’টি বাংলা ছবি, যাদের প্রেক্ষাপট মূলত রাজনৈতিক। একটির নাম ‘নকশাল’, অন্যটি ‘শীর্ষেন্দুর ডায়েরি’।
‘মেঘের মেয়ে’ নামে আরও একটি ছবি মুক্তির অপেক্ষায়। আর এই ছবিতে পুরোদস্তুর উপস্থিত নকশাল মতাদর্শ নিয়ে টানাপড়েন, অন্তর্দ্বন্দ্ব ও জঙ্গলমহলে মাওবাদী কার্যকলাপ। তা সত্ত্বেও ‘মেঘের মেয়ে’ সযত্নে এড়িয়ে গিয়েছে লালগড়কে। অবশ্য ‘শীর্ষেন্দুর ডায়েরি’-র কেন্দ্রীয় চরিত্রের একটি সংলাপ ছুঁয়ে যায় ওই উত্তাল সময়কে। ‘‘সূর্যগড়ে রোজ একটা করে খুন হচ্ছে।’’ সূর্যগড় বলতে আসলে কায়দা করে লালগড়কেই বোঝানো হয়েছে। আর ‘নকশাল’-এ সত্তর দশকের এক বিপ্লবী বর্তমান আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক ব্যবস্থায় নিজেকে মানিয়ে নিতে না পেরে তীব্র অস্তিত্বের সঙ্কটে ভোগেন। কিন্তু সেই প্রাক্তন বিপ্লবী (ভূমিকায় মিঠুন চক্রবর্তী) যেন জঙ্গলমহলের খোঁজই রাখেন না!
এই তিনটি রাজনৈতিক ছবির পরিচালক আর অভিনেতারা কার্যত স্বীকার করে নিচ্ছেন, তাঁদের কাজে লালগড় আন্দোলনকে ধরার সুযোগ ছিল এবং সময়ের দাবি মেনেই ওই ঘটনাবলি নিয়ে ছবি হওয়া উচিত। তা হলে হচ্ছে না কেন? ছত্তীসগঢ় ও ঝাড়খণ্ডের মাওবাদী ডেরায় দীর্ঘ সময় পড়ে থেকে ‘মাই ডেজ উইথ মাওয়িস্ট আর্মি’ তথ্যচিত্র তৈরি করা সৌমিত্র ঘোষদস্তিদারের মতে, বিষয়টা নিয়ে পড়াশোনা, চর্চার বড্ড অভাব। তাঁর কথায়, ‘‘ক’জন জানেন যে, পশ্চিমবঙ্গে মাওবাদীরা প্রথম গণ মিলিশিয়া তৈরি করেছিল লালগড়ে। ওই এলাকা ও আশপাশের বিস্তীর্ণ তল্লাটে দীর্ঘ সময় রাষ্ট্রের কোনও উপস্থিতিই ছিল না! এই ধরনের ছবি তৈরি করার প্রয়োজনীয় নিষ্ঠা, দায়বদ্ধতা খুব কম লোকেরই আছে।’’
‘মেঘের মেয়ে’-র পরিচালক গায়ক-অভিনেতা পল্লব কীর্তনীয়া। তাঁর যুক্তি, ‘‘লালগড় আন্দোলন শুরুর আগেই চিত্রনাট্য লেখা হয়ে গিয়েছিল। পরে লালগড় ঢোকালে ফোকাস নষ্ট হত। লালগড়ের ক্যানভাস অনেক বড়।’’
‘পদাতিক’-এর নায়ক সুমিত, ধৃতিমান চট্টোপাধ্যায় ‘নকশাল’-এ এক মিডিয়া টাইকুনের ভূমিকায়। তাঁর মতে, ‘‘এখন আমরা অনেক অসহিষ্ণু সময়ের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছি। যাঁরা ছবি করেন, তাঁরা হয়তো ঝামেলার মধ্যে যেতে না চেয়ে এ সব ঘাঁটাঘাঁটি করার ঝুঁকি নিচ্ছেন না।’’ একই মত পরিচালক সুদীপ্ত দে’র। ‘‘পরিস্থিতি খুব খারাপ। ‘শীর্ষেন্দুর ডায়েরি’ও গত বছর সেন্সর বোর্ড আটকে দিয়েছিল। বিতর্কিত বিষয় নিয়ে ছবি তৈরি করার জন্য গবেষণায় যেমন খামতি, তেমনই প্রযোজক পাওয়া মুশকিল। পরিচালকদের সাহসেরও অভাব আছে,’’ অকপট তিনি।
তবে রাজ্যের মন্ত্রী তথা সাংস্কৃতিক কর্মী ব্রাত্য বসুর বক্তব্য, ‘‘চলচ্চিত্র অনেক ক্ষেত্রেই বিনোদনের মাধ্যম হয়ে দাঁড়িয়েছে। সমস্যাটা সেখানেই।’’ ব্রাত্যরই পরিচালিত, ২০১০-এ মুক্তি পাওয়া ‘তারা’ ছবিতে লালগড়ের আন্দোলনের কয়েকটি ভিডিও ফুটেজ ব্যবহার করা হয়েছিল। ছবিতে মাওবাদীদের ল্যান্ডমাইন বিস্ফোরণ ও গুপ্তহত্যা, নিরপরাধের উপরে পুলিশি পীড়নের প্রেক্ষাপটে প্রেম কাহিনি আঁকা হলেও লালগড় আন্দোলনের সময়কার জঙ্গলমহলের চিত্র যে তুলে ধরা হয়নি, সেটা ব্রাত্য মেনে নিচ্ছেন। ব্রাত্যর পরিচালনায় এখন মঞ্চস্থ হচ্ছে ‘বোমা’, যে নাটক তুলে ধরেছে বাংলার প্রথম সশস্ত্র বিপ্লবের সময়কাল। কিন্তু বাংলার আপাতত শেষ সশস্ত্র বিপ্লবী অর্থাৎ মাওবাদীরা যখন গণ আন্দোলনকে চালনা করছে, ওসি-কে অপহরণ করে যুদ্ধবন্দি ঘোষণা করছে, সেই সময়কাল তুলে ধরবেন কে? পল্লব কীর্তনীয়া ও সুদীপ্ত দে অবশ্য বলছেন, ‘‘ভবিষ্যতে অবশ্যই লালগড় নিয়ে ছবি করব। ওই সময়কাল ও আন্দোলনের পরতে পরতে কাহিনির উপাদান ভর্তি।’’
আপাতত সেই আশাতেই আছে লালগড়।