শোভন চট্টোপাধ্যায় ও বৈশাখী বন্দ্যোপাধ্যায়। —ফাইল চিত্র
পরিস্থিতি যে মোড় নিচ্ছে, বোঝা গিয়েছিল রবিবারই। তৃণমূল বেহালা এলাকায় রত্না চট্টোপাধ্যায়ের গুরুত্ব বাড়াতেই পাল্টা সক্রিয়তার আঁচ মিলতে শুরু করেছিল কলকাতার প্রাক্তন মেয়রের অন্দর মহলে। বিজেপি নেতৃত্বের সঙ্গে শোভন শিবিরের যোগাযোগ আচমকা বেড়ে গিয়েছিল ২৪ ঘণ্টার মধ্যে। আর মঙ্গলবার পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে দেখা করে প্রায় ‘শেষ কথা’ বলে দিয়ে এলেন বৈশাখী বন্দ্যোপাধ্যায়। ‘‘অনেক দিনের সম্পর্ক তো। শেষ যদি হয়, তা হলে সেটাও ভাল ভাবেই হওয়া উচিত। তাই যা বলার, দেখা করেই বলে গেলাম।’’ তৃণমূল মহাসচিবের বাড়ি থেকে ফেরার পরে এমনই বললেন বৈশাখী বন্দ্যোপাধ্যায়।
শোভন চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে বিজেপিতে আনুষ্ঠানিক ভাবে যোগ দেওয়ার পরেও তৃণমূলের মহাসচিব তথা রাজ্যের শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের বাড়িতে বার বারই গিয়েছেন বৈশাখী বন্দ্যোপাধ্যায়। কখনও কখনও বিকাশ ভবনে গিয়েও পার্থর সঙ্গে বৈঠক করে এসেছেন বৈশাখী। তবে এই সব বৈঠক রাজনৈতিক নয়, তাঁর কলেজে যে সমস্যা দীর্ঘ দিন ধরে চলছে, তা নিয়ে আলোচনার জন্যই শিক্ষামন্ত্রীর সঙ্গে তাঁকে দেখা করতে হয় বলে বৈশাখী বরাবর জানাতেন। পার্থ চট্টোপাধ্যায় নিজেও সে কথাই বলতেন। কিন্তু এ দিনের বৈঠকের পরে পার্থ এবং বৈশাখী, দু’জনেই জানিয়েছেন যে, কলেজের সমস্যার পাশাপাশি শোভনকে নিয়েও কথা উঠেছিল।
মিল্লি আল-আমিন কলেজ সূত্রের খবর, দীর্ঘ দিন ধরে কলেজটিতে চলতে থাকা অচলাবস্থার সমাধান পার্থ চট্টোপাধ্যায় ইচ্ছা করেই করছেন না বলে মনে করছেন ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষা বৈশাখী বন্দ্যোপাধ্যায়। শোভন চট্টোপাধ্যায় যত দিন না তৃণমূলের হয়ে সক্রিয় হচ্ছেন, তত দিন বৈশাখীর কলেজের সমস্যাকে ঝুলিয়ে রাখা হবে— এই রকম ধারণাও প্রাক্তন মেয়রের শিবিরে তৈরি হচ্ছিল। শোভন ঘনিষ্ঠরা জানাচ্ছেন, আজ পার্থর বাড়িতে হওয়া বৈঠকে সে কথা প্রায় সরাসরিই বলে দিয়েছেন বৈশাখী বন্দ্যোপাধ্যায়। ফলে পার্থর সঙ্গে বৈশাখীর কথোপকথন একটা পর্যায়ে কিছুটা উত্তপ্ত হয়ে ওঠে বলেও খবর।
শোভন ২০১৯-এর ১৪ অগস্ট বিজেপিতে আনুষ্ঠানিক ভাবে যোগ দিয়েছিলেন ঠিকই। কিন্তু বিজেপির হয়ে সক্রিয় তিনি হননি। শোভনের সঙ্গে বিজেপি নেতৃত্বের মনোমালিন্যের আঁচ পেয়েই তৃণমূলও ফের সক্রিয় হয়ে উঠেছিল। শোভন ফিরুন বা না ফিরুন, বিজেপির হয়ে সক্রিয় যাতে না হন, তা নিশ্চিত করার চেষ্টা শুরু হয়েছিল। দলের মহাসচিব পার্থ চট্টোপাধ্যায়ই মূলত সে দিকে নজর রাখছিলেন। বৈশাখী বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে নিরন্তর যোগাযোগই ছিল পার্থর সেতু। কিন্তু যাঁর সঙ্গে শোভনের বিবাহ বিচ্ছেদের মামলা চলছে, পুরভোটের মুখে এসে শোভনের খাসতালুক হিসেবে পরিচিত বেহালায় সেই রত্নাকেই যে ভাবে ক্রমশ সামনের সারিতে নিয়ে চলে এসেছে তৃণমূল, তাতে বেজায় অসন্তুষ্ট প্রাক্তন মেয়র। শনিবার বেহালায় রত্নাকে পাশে নিয়ে সংবাদ মাধ্যমের মুখোমুখিও হয়েছিলেন তৃণমূল মহাসচিব পার্থ। শোভন বিধায়ক হিসেবে ‘নিষ্ক্রিয়’, তাই রত্নাকে দায়িত্ব দিতে হল— এমন মন্তব্যও পার্থ করেছিলেন সেখানে। তৃণমূল মহাসচিবের ওই মন্তব্যের পরে আরও জটিল হয় পরিস্থিতি। সে জটিলতা কাটার আশা না করাই যে ভাল, মঙ্গলবার পার্থর বাড়ি গিয়ে বৈশাখী সেই ইঙ্গিতই দিয়ে এসেছেন বলে জানা যাচ্ছে।
আরও পড়ুন: পুরভোটে বাম-কংগ্রেস আসন সমঝোতা চূড়ান্ত হওয়ার পথে
পার্থ চট্টোপাধ্যায় নিজে এ দিন জানিয়েছেন যে, কলেজের সমস্যা নিয়েই বৈশাখী বন্দ্যোপাধ্যায় কথা বলতে গিয়েছিলেন তাঁর বাড়িতে। কিন্তু শোভন বিজেপির হয়ে সক্রিয় হয়ে উঠতে পারেন বলে যে জল্পনা গত রবিবার থেকে চলছে রাজ্যের রাজনৈতিক শিবিরে, সে বিষয়েও যে কথা উঠেছিল, তা-ও পার্থ স্বীকার করেন। শোভনকে তৃণমূলের হয়ে সক্রিয় করার জন্য অনেক চেষ্টা হয়েছে, তিনি নিজে চেষ্টা করেছেন, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ভাইফোঁটা দিয়েছেন, এর পরেও আর কী কী করলে শোভন সক্রিয় হবেন? পার্থ চট্টোপাধ্যায় এ দিন এমন প্রশ্নই তুলেছেন সংবাদমাধ্যমের সামনে।
শোভনের ঘনিষ্ঠ মহল সূত্রে অবশ্য জানা গিয়েছে, তৃণমূলের কাছ থেকে শোভন আর কিছুই প্রত্যাশা করছেন না বলে পার্থকে জানিয়ে দিয়েছেন বৈশাখী। পার্থর তরফ থেকে এ দিনও পরিস্থিতি সামলানোর চেষ্টা করার আশ্বাস ছিল বলে জানা গিয়েছে। কিন্তু আর কিছুই সামলানোর নেই, কারও অনুরোধেই তিনি আর শোভনকে আটকাবেন না, যে দিকে সম্মান রয়েছে, শোভন নিজের সিদ্ধান্তেই এ বার সে দিকে সক্রিয় হবেন— এমন বার্তাই পার্থকে এ দিন বৈশাখী দিয়ে দিয়েছেন বলে খবর। নিজের কর্মক্ষেত্র সংক্রান্ত সমস্যা নিয়েও শিক্ষামন্ত্রীকে এ দিন বৈশাখী বেশ কিছু কঠিন কথা শুনিয়েছেন বলে খবর। তাঁর কর্মক্ষেত্রকে কেন শোভনের রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের সঙ্গে জুড়ে দেওয়া হচ্ছে— বৈশাখী এ দিন এই প্রশ্ন তোলেন বলে জানা গিয়েছে। বৈশাখীর কর্মক্ষেত্রের সমস্যা না মেটানোর ‘ভয় দেখিয়ে’ শোভনের উপরে আর চাপ তৈরি করা যাবে না— শোভন শিবির থেকে মঙ্গলবার এই বার্তা দেওয়াও শুরু হয়েছে।
আরও পড়ুন: জ্যোতিরাদিত্যের পর বিজেপির লক্ষ্য কি তারুর! মোদীর চিঠি ঘিরে বাড়ছে জল্পনা
কলকাতার প্রাক্তন মেয়রকে যে আর আলাদা গুরুত্বের চোখে দেখা হচ্ছে না, শোভনের শর্ত লঙ্ঘন করে রত্নার উত্থান ঘটিয়েই সে বার্তা তৃণমূল দিয়ে দিয়েছে বলে মত রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের একাংশের। শোভন ঘনিষ্ঠরাও তেমনই মনে করছেন। আর সেই ধারণা থেকেই পাল্টা রণকৌশলও শোভন নির্ধারণ করতে চাইছেন বলে তাঁর ঘনিষ্ঠরা জানাচ্ছেন। বিজেপির সঙ্গে সে বিষয়ে শোভনের কথাবার্তাও শুরু হয়েছে বলে খবর। শোভনের ওয়ার্ডে এবং শোভনের বিধানসভা কেন্দ্রে তাঁকে ‘অপ্রাসঙ্গিক’ প্রমাণ করতে যেমন রত্নাকে সামনে নিয়ে এল তৃণমূল, ঠিক সেভাবেই প্রাক্তন মেয়রের খাসতালুকে এ বার বৈশাখীকে সামনে নিয়ে আসা হতে পারে বলে খবর। শোভন যদি সক্রিয় হন, তা হলে গোটা কলকাতার জন্যই হবেন। কিন্তু নিজের খাসতালুকে তৃণমূলকে জোরদার ধাক্কা দিতে পারাটা শোভনের জন্য বিশেষ ভাবে জরুরি। যাঁকে কেন্দ্র করে তৃণমূলের সঙ্গে তাঁর টানাপড়েন বেড়েছিল, সেই বৈশাখী বন্দ্যোপাধ্যায়কেই যদি এই ভোটে বেহালায় প্রতিষ্ঠা করে দিতে পারেন শোভন, তা হলে তার চেয়ে বড় ‘মধুর প্রতিশোধ’ আর কিছু হবে না। বলছেন শোভন ঘনিষ্ঠরা।
আরও পড়ুন: পরিবারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ? সিন্ধিয়া দিয়ে শুরু, এর পর কি আরও অনেকে
বেহালা পূর্বে রত্না চট্টোপাধ্যায়ের দায়িত্বপ্রাপ্তিকে অবশ্য গুরুত্ব দিতে চাইছেন না বৈশাখী বন্দ্যোপাধ্যায়। পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে বৈঠকের পরে এ দিন তিনি আনন্দবাজারকে বলেন, ‘‘যে কর্মসূচির (বাংলার গর্ব মমতা) দায়িত্ব ওঁকে (রত্নাকে) দেওয়া হয়েছে, সেই কর্মসূচির দায়িত্ব তো পশ্চিমবঙ্গের সব বিধানসভা কেন্দ্রেই কেউ না কেউ পেয়েছেন। কারও নাম নিয়ে কি আলোচনা হচ্ছে? হচ্ছে না তো! কারও ওটা কোনও আলোচনায় আসার মতো দায়িত্বই নয়। কিন্তু বেহালা পূর্বের দায়িত্ব যিনি পেলেন, তাঁকে নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। কারণ তিনি এখনও শোভন চট্টোপাধ্যায়ের স্ত্রী হিসেবেই পরিচিত। শোভনবাবুর পরিচয়েই যিনি এখনও পরিচিত, তাঁকে সামনে এনে শোভনবাবুকে ধাক্কা দেওয়ার চেষ্টা কোনও বুদ্ধিমানে করতে পারেন কি না, একবার ভেবে দেখুন।’’ বৈশাখী আরও বলেন, ‘‘শোভন চট্টোপাধ্যায়ের বিকল্প হিসেবে যাঁরা রত্নাকে বেছে নিতে চান, সেই দল রাজনৈতিক ভাবে কতটা দেউলিয়া, তা বোধ হয় বলে দিতে হয় না। ওই দলের ভবিষ্যতের জন্য আমার শুভেচ্ছা রইল।’’
তৃণমূলের সঙ্গে দূরত্ব যে বিপুল বেড়ে গিয়েছে, বৈশাখীর এই মন্তব্যে তার আভাস রয়েছে বলে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন। ‘‘পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে যে দীর্ঘ সুসম্পর্ক ছিল, তা যদি শেষ হয়, তা হলে মধুরেণ সমাপয়েৎ হওয়াই ভাল। সেই কারণেই দেখা করে যা বলার বলে এলাম,’’ বৈশাখীর এই মন্তব্যকেও বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ হিসেবে দেখছে রাজনৈতিক শিবির। বিজেপির হয়ে শোভনের সক্রিয় হয়ে ওঠা সময়ের অপেক্ষা, এমনও দাবি করছেন শোভন শিবিরের কেউ কেউ। বৈশাখী এ দিন সে প্রসঙ্গে কোনও মন্তব্য করতে চাননি। তবে তৃণমূলের সঙ্গে পথ চলা শেষ কি না, সে প্রশ্নের উত্তরে বলেছেন, ‘‘সদ্য একটা ৮ মার্চ গেল। কয়েক বছর আগে এই রকম একটা ৮ মার্চেই আমাকে ওয়েবকুপা থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছিল। যে দিন ওই অপসারণ ঘটেছিল, সে দিন থেকেই তো তৃণমূলের সঙ্গে আমার পথ চলা শেষ হয়ে গিয়েছে। নতুন করে আর শেষ হওয়ার তো কিছু নেই। ’’