ভোগান্তি বেশি গ্রাম-মফস্‌সলে

টাকা পাব এমন এটিএম কোথায় পাই বলতে পারেন

কতটা পথ পেরোলে চালু এটিএম বা তা থেকে টাকা পাওয়া যায়— শুক্রবার এই প্রশ্নে হাবুডুবু খেল গ্রামীণ পশ্চিমবঙ্গ। সরকারি বিজ্ঞপ্তিমতো এটিএম খোলার কথা ছিল এ দিন। কিন্তু রাজ্যবাসীর অভিজ্ঞতা, দিনভর উত্তর থেকে দক্ষিণবঙ্গের বেশির ভাগ এটিএমে টাকার দেখা মেলেনি।

Advertisement

নিজস্ব প্রতিবেদন

শেষ আপডেট: ১২ নভেম্বর ২০১৬ ০৪:০৭
Share:

বন্ধ এটিএম। ভিড় লাগোয়া ব্যাঙ্কে। শুক্রবার বি বা দী বাগে। ছবি: স্বাতী চক্রবর্তী।

কতটা পথ পেরোলে চালু এটিএম বা তা থেকে টাকা পাওয়া যায়— শুক্রবার এই প্রশ্নে হাবুডুবু খেল গ্রামীণ পশ্চিমবঙ্গ। সরকারি বিজ্ঞপ্তিমতো এটিএম খোলার কথা ছিল এ দিন। কিন্তু রাজ্যবাসীর অভিজ্ঞতা, দিনভর উত্তর থেকে দক্ষিণবঙ্গের বেশির ভাগ এটিএমে টাকার দেখা মেলেনি। হয় ‘লিঙ্ক’ নেই, নয় ‘টাকা নেই’ অথবা বেমালুম ঝাঁপ বন্ধ। দৈবাৎ কোনওটা খোলা পাওয়া গেলেও সেখানে দীর্ঘ লাইন। দ্রুত ফুরিয়েছে টাকাও।

Advertisement

এমনিতেই এ রাজ্যে কলকাতার বাইরে দু’চারটে বড় শহর ছাড়া শহরতলি এব‌ং গ্রামীণ এলাকায় ব্যাঙ্কের সংখ্যা খুব কম। এটিএম আরও কম। অনলাইন ওয়ালেট বা ডেবিট-ক্রেডিট কার্ড ব্যবহার করে লেনদেনের সুযোগও যৎসামান্য। এই অবস্থায় শহরেই যেখানে নাভিশ্বাস ওঠার অবস্থা, সেখানে গ্রামাঞ্চলের অবস্থা আরও খারাপ।

বৃহস্পতিবার প্রত্যাশা থাকলেও রাজ্যের বেশির ভাগ এটিএম থেকেই টাকা তোলা যায়নি। ব্যাঙ্কিং মহলের অনুমান ছিল, ব্যাঙ্কের শাখা লাগোয়া এটিএমগুলোই চালু করার চেষ্টা হবে প্রথমে। কতকটা তেমনই আঁচ করে জনতা ভিড়ও জমিয়েছিল এ দিন সকাল থেকে। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রেই লাভ হয়নি। মুর্শিদাবাদের বহরমপুর শহর লাগোয়া চোঁয়াপুর, ভাকুড়ি, পঞ্চাননতলায় রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কের শাখা লাগোয়া এটিএম কাউন্টার বন্ধ ছিল। মেদিনীপুর সদরে একটি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কের ২৬টি এটিএমের একটিও খোলেনি এ দিন। হাওড়ার উলুবেড়িয়া সদর এবং আলিপুরদুয়ারের ফালাকাটায় প্রায় কোনও এটিএমই খোলেনি। পূর্ব মেদিনীপুরের তমলুকে বেশির ভাগ এটিএমের ঝাঁপ বন্ধ ছিল। প্রায় একই ছবি দক্ষিণ ২৪ পরগনার ক্যানিংয়ে। কোচবিহারে প্রায় সমস্ত এটিএম বিকেল পর্যন্ত চালু হয়নি।

Advertisement

নদিয়ার কৃষ্ণনগর, শান্তিপুর, মাজদিয়ায় বিভিন্ন ব্যাঙ্কের এটিএমে নগদ ছিল ‘বাড়ন্ত’। তাই সেগুলো খুললেও বন্ধ হতে সময় লাগেনি। পুরুলিয়া জেলায় মোট এটিএমের সংখ্যা ১৮১টি। তার মধ্যে সাকুল্যে ২০টির মতো বিকেলের দিকে খোলে। ফলে, লোকজনের হয়রানি চরমে ওঠে। উত্তর ২৪ পরগনার মধ্যমগ্রাম চৌমাথার কাছে একটি এটিএমে টাকা ফুরিয়ে যাওয়ায় বিক্ষোভ দেখায় জনতা। পুলিশ এটিএমটি বন্ধ করে দেয়। স্বরূপনগরের একটি এটিএমে টাকা না বেরোনোয় এক যুবক এটিএমের রসিদ পুড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেন বলে অভিযোগ। পুলিশ তাঁকে আটক করে।

বীরভূমের রামপুরহাট থানার প্রান্তিক গ্রাম মাসড়া। গ্রামের অধিকাংশ দিনমজুর। পাথরখাদানেও কাজ করেন অনেকে। গ্রাম থেকে তিন কিলোমিটার দূরে কাষ্ঠগড়ায় একটি গ্রামীণ ব্যাঙ্কের শাখা রয়েছে। কিন্তু সেখানে এটিএম নেই। আর এগারো কিলোমিটার দূরে রয়েছে একটি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কের এটিএম। মাসড়ার বাসিন্দা মুদির দোকানদার তারক ধরের অভিজ্ঞতা, ‘‘বৃহস্পতি এবং শুক্রবার দু’দিন ওই দুটো ব্যাঙ্কে গিয়েছিলাম। বেশ কয়েক ঘণ্টা দাঁড়ানোর পরেও লাইন এগোচ্ছিল না। তাই ফিরে এসেছি। অথচ, ব্যবসা চালু রাখতে এখনও পর্যন্ত পাঁচশো, হাজারের নোট ভাঙিয়ে চলেছি!’’

প্রায় একই ধরনের অভিজ্ঞতা, উত্তর দিনাজপুরের ইটাহার ব্লকের বালিয়া, কয়লাডাঙ্গি, জয়হাট ও বৈদড়ার বাসিন্দাদের। প্রশাসনের হিসেবে ওই এলাকাগুলি থেকে ১৫-২০ কিলোমিটারের মধ্যে এটিএম কাউন্টার নেই। আশপাশে নেই ডাকঘরও। বৈদড়ার কৃষিজীবী প্রফুল্ল বর্মন ও সনাতন দাসেরা এ দিন ৩৫ কিলোমিটার দূরের ব্যাঙ্কে গিয়ে বাড়িতে থাকা অচল নোট বদলেছেন।

রাজ্য ভিত্তিক ব্যাঙ্ক কর্তৃপক্ষের সংগঠন ‘স্টেট লেভেল ব্যাঙ্কার্স কমিটি’ (এসএলবিসি)-র এক কর্তা জানান জানান, নতুন ৫০০ বা ২,০০০ টাকার নোট পর্যাপ্ত না থাকায় শহরাঞ্চলে ব্যাঙ্কের কাছাকাছি জায়গার এটিএমগুলিতে ১০০ টাকার নোট ভরা হয়েছে। আর প্রত্যন্ত এলাকায়? জবাব দেননি তিনি। পরিসংখ্যানেও স্পষ্ট, এটিএম কাউন্টারের সংখ্যার নিরিখে এ রাজ্যের গ্রামাঞ্চল পিছিয়ে রয়েছে শহরাঞ্চলের চেয়ে। এসএলবিসি-র ওয়েবসাইট অনুযায়ী, চলতি বছরের জুন মাস পর্যন্ত এ রাজ্যে সরকারি ও বেসরকারি সব ধরনের ব্যাঙ্ক মিলিয়ে এটিএম কাউন্টারের সংখ্যা ১০,৫৮১। তার মধ্যে যেখানে মেট্রো-শহরে ২,৯৯৬টি, শহরে ৩,০১৩টি রয়েছে, সেখানে গ্রামে এটিএম কাউন্টারের সংখ্যা ২,৪৫৪টি।

এলাকায় কোনও এটিএম কাউন্টার নেই। তাই মালদহের হরিশ্চন্দ্রপুরের বিহার সীমানা ঘেঁষা বিষ্ণুপুর এলাকার বাসিন্দা সাত সকালে ১০ কিলোমিটার উজিয়ে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কের চাঁচল শাখায় লাইন দিয়েছিলেন। সাত ঘণ্টা বাদে হাতে পেলেন মাত্র হাজার টাকা। কারণ, ততক্ষণে ব্যাঙ্কের ভাঁড়ারে ১০০ টাকার নোট ফুরিয়ে গিয়েছে।

এমন পরিস্থিতিতে কিছুটা সুরাহা হতে পারত ডাকঘরের মাধ্যমে। কিন্তু সে গুড়েও বালি পড়েছে রাজ্যের বহু জায়গায়। টাকার জোগান না থাকায় গ্রাহকদের ফিরিয়েছে ডাকঘর।

অন্তত গোটা পাঁচেক কাউন্টারে ঘুরেও নগদ দু’হাজার টাকা তুলতে না পারায় ক্ষোভ লুকোলেন না দুবরাজপুরের মেটেলা গ্রামের কার্তিক মণ্ডল। জানতে চাইলেন, ‘‘গিয়ে হাতে টাকা পাব, এমন এটিএম কোথায় পাই বলতে পারেন!’’

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement