শুনে প্রথমটায় ঘাবড়েই গিয়েছিলেন। ডাক্তারবাবুর হল কী!
দক্ষিণ কলকাতায় পসারওয়ালা রিউম্যাটোলজিস্টের চেম্বার। বাত-রোগীদের বেল্ট নির্মাতা এক কোম্পানির মেডিক্যাল রিপ্রেজেন্টেটিভ (এমআর) যুবকটি এসেছিলেন দামি উপহার নিয়ে। চিকিৎসক কখনও উপহারে না করেন না। তিনিই কিনা কোম্পানির গিফ্ট ফিরিয়ে দিচ্ছেন!
রহস্য খোলসা হতে দেরি হয়নি। ডাক্তারবাবু বললেন, ‘‘ও সব এখন থাক। আগে বলো, কতগুলো বড় নোট ভাঙিয়ে দেবে।’’
মুখ ব্যাজার করেও ডাক্তারবাবুর গছানো বেশ কিছু পাঁচশো-হাজারি নোটের বান্ডিল পকেটে পুরতে বাধ্য হয়েছেন এমআর। সেগুলো ভাঙানোর বন্দোবস্ত করতে হয়েছে সাত তাড়াতাড়ি। উপায় কী? টক্করের জমানায় কম্পিটিটরদের যে এক ইঞ্চি জমিও ছাড়া যাবে না!
এক ওষুধ কোম্পানির প্রতিনিধিরও একই অভিজ্ঞতা। মধ্য কলকাতার নামজাদা গ্যাস্ট্রোএন্টেরোলজিস্টের চেম্বারে গিয়েছিলেন, সপরিবারে দক্ষিণ আফ্রিকা ঘোরানোর ‘অফার’ নিয়ে। আপত্তি দেখে তিনি থ। শেষমেশ তাঁকেও খান কুড়ি বান্ডিল ব্যাগে ভরতে হয়েছে। ডাক্তারবাবু বিদেশভ্রমণ চান না, চান খুচরো।
বস্তুত এটাই এই মুহূর্তে কিছু চিকিৎসকের কাছে সবচেয়ে কাম্য ‘কমিশন।’ পাশাপাশি প্রধানমন্ত্রীর নোট বাতিলের ঘোষণার জেরে কালো টাকার মালিক ওই চিকিৎসকেরা যত না সমস্যায় পড়েছেন, তার তিন গুণ ঝক্কি পোহাচ্ছেন বহু এমআর। স্টেন্ট সংস্থার এক জনের কথায়, ‘‘পকেটে একশোর নোটের গোছা নিয়ে ঘুরছি। ডাক্তারবাবুদের খুশি করতে হবে।’’
এবং একশো মানে একশোই। অর্থোপেডিক ইমপ্লান্ট সংস্থার এমআর দু’হাজারি নোটের বান্ডিল দিতে গিয়েছিলেন অর্থোপেডিক সার্জনকে। ডাক্তারবাবু নেননি। পাছে দু’হাজারও বাতিল হয়ে যায়, সেই ভয়ে। অগত্যা ফের একশো নিয়ে যেতে হয়েছে। এত একশো জোগাড় করছেন কী ভাবে?
এমআর-রা মাথা চাপড়াচ্ছেন। ‘‘রাত-দিন ভুলে অফিসপাড়ায় হত্যে দিয়ে পড়ে আছি। মোটা বাট্টা দিয়ে নোট বদলাচ্ছি।’’— বলছেন এক জন। কারও অভিযোগ, এই বাজারে কিছু চিকিৎসক নগদ টাকার ছোঁয়াই বাঁচাতে উদগ্রীব। তাঁরা কমিশন চাইছেন সোনার গিনি বা গয়নায়।
চাহিদা বুঝে কোম্পানিগুলোও নিজেদের তৈরি করছে। একটি ইনসুলিন সংস্থা যেমন কিছু ডাক্তারকে এসএমএস পাঠিয়ে জানাচ্ছে, তারা এক কোটি টাকা পর্যন্ত ব্যাঙ্কে রাখার ব্যবস্থা করবে। একটি ল্যাবের অফার— আমাদের অ্যাকাউন্টে দশ লাখ পর্যন্ত নিশ্চিন্তে রাখুন। দক্ষিণ কলকাতার এক গাইনিও সে বার্তা পেয়েছেন। তাঁর উপলব্ধি, ‘‘ক্যানসার ও বন্ধ্যত্বের চিকিৎসায় খরচের সীমা-পরিসীমা নেই। তাই কোম্পানিগুলো ডাক্তারকে হাতে রাখতে মরিয়া।’’
সূত্রের খবর: শহরের কয়েকটি বড় ল্যাব বাস্তবিকই কিছু ডাক্তারের কালো টাকাকে নিজস্ব আয় হিসেবে দেখিয়ে অ্যাকাউন্টে জমা রাখছে। এতে তো বিস্তর আয়কর গুণতে হবে!
এক ল্যাব-কর্তার ব্যাখ্যা, ‘‘তা হোক। ডাক্তারেরা তো মুঠোয় থাকবেন। যা রোগী পাঠাবেন, তাতে রোজগার হবে বেশি।’’ চিকিৎসকদের একাংশের আক্ষেপ, ‘‘এতে রোগীর পকেট কেটে অপ্রয়োজনীয় পরীক্ষা করানো আরও বাড়বে।’’ এক পেসমেকার নির্মাতা নিজেদের বেশ কিছু এজেন্টের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট ‘অফার’ করেছে কিছু ডাক্তারকে। তাতে আড়াই লাখ করে ভাগে-ভাগে টাকা রাখা যাবে। ট্যাক্স বসবে না। পরে তা ‘সাদা’ হয়ে ফিরবে। বদলে কোম্পানির পেসমেকার-ই লিখতে হবে। অর্থোপেডিক ইমপ্লান্ট সংস্থার এক কর্তা বলেন, ‘‘আমরাও অফার দিচ্ছি। টাকা আমাদের অ্যাকাউন্টে রাখুন। ব্যাকডেটে বিল দেব। আমাদের প্রডাক্ট প্রেসক্রাইব করে যান।’’
স্বাস্থ্য মহলের খবর: বড় বড় বেসরকারি হাসপাতাল লেনদেন করে মূলত চেক মারফত। সেখানকার অ্যাকাউন্টে কালো টাকা ঢোকানো মুশকিল। তাই এমন সব সংস্থাই চিকিৎসকদের একাংশের কাছে ‘ত্রাতা’ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
নিজস্ব নার্সিংহোম থাকার সুবাদে কিছু ডাক্তারের আবার বিভিন্ন কোম্পানির কাছে সব সময়ে কিছু দেনা থাকে। কোম্পানিরা এখন ওঁদের কাউকে কাউকে প্রস্তাব দিচ্ছে, তারা এক কোটি টাকা পর্যন্ত দেনা দেখিয়ে দেবে। সেই মতো জিনিসপত্রের বিলও বানিয়ে দেবে। ধার শোধের নামে ডাক্তারবাবু নিজের কালো টাকা কোম্পানির অ্যাকাউন্টে ফেলে সাদা করে নিন। শর্ত একটাই— টানা ক’বছর নার্সিংহোমের যাবতীয় জিনিসপত্র ওই কোম্পানিই জোগাবে।
সূত্রের খবর, কিছু নার্সিংহোম-মালিক রাজিও হয়েছেন। যা শুনে চিকিৎসকদের সর্বভারতীয় সংগঠন ‘ইন্ডিয়ান মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশন’-এর পশ্চিমবঙ্গ শাখার তরফে শান্তনু সেনের প্রতিক্রিয়া, ‘‘প্রতি পেশায় কিছু অসৎ লোক থাকে। তাদের সঙ্গে বাকিদের গুলিয়ে ফেলা ঠিক নয়।’’
যাঁরা ঘুরপথে কালোকে সাদা করতে চাইছেন, তাঁরা নির্ঘাৎ বিপদে পড়বেন বলে শান্তনুবাবুদের বিশ্বাস।