উদ্বোধনের অনুষ্ঠানে। নিজস্ব চিত্র
বাতাসে বাতাসে চার পাশের পনেরো কিলোমিটারে ছড়িয়ে থাকত। এ বার, শরতের আকাশের সোনা রোদ্দুরে সেই গান ভেসে যাচ্ছে দূর থেকে দূরে। বিভুঁইয়ে তো বটেই, বিদেশে বসেও শোনা যাচ্ছে ‘নিত্যানন্দ জনবাণী’ রেডিয়োর সম্প্রচার। সম্প্রতি পুরুলিয়ার পুঞ্চার ওই কমিউনিটি রেডিয়ো স্টেশনের ওয়েবপেজ ও মোবাইল অ্যাপ্লিকেশন চালু হয়েছে। উদ্বোধনে এসেছিলেন ইউনিসেফের ‘কমিউনিকেশন ফর ডেভেলপমেন্ট’-এর দিল্লির দফতরের প্রধান সিদ্ধার্থ শ্রেষ্ঠা। তিনি বলেন, ‘‘পুঞ্চার লৌলাড়া নিত্যানন্দ জনবাণী রেডিয়োর পরিধি বেড়ে গেল। কম্পিউটার বা মোবাইল ফোন থেকেও এ বার এর অনুষ্ঠান শোনা যাবে।’’
ইন্টারনেটের যুগে রেডিয়োর শ্রোতা ক’জন? রেডিও স্টেশনের পক্ষে নির্মাল্য মুখোপাধ্যায় দাবি করছেন, অনেক। তিনি জানান, ২০১০ সাল থেকে পুঞ্চায় এই কমিউনিটি রেডিয়ো স্টেশন আবহাওয়া, কৃষি, শিক্ষা, স্বাস্থ্য এবং স্থানীয় লোকাচার সম্পর্কিত অনুষ্ঠান করে আসছে। সম্প্রচার হয় সকাল ৬টা থেকে রাত সাড়ে ৯টা পর্যন্ত। পুঞ্চার হরিহরপুরের হরিপদ মাহাতো সস্তার মণিহারি জিনিস নিয়ে সাইকেলে ঘুরে ঘুরে ফেরি করেন। তিনি বলছিলেন, ‘‘আমিও শুনি। কুড়মালিতে অনুষ্ঠান হয়। বাংলাটাও আমাদের মতো করেই বলে রেডিয়োতে। ভাল লাগে।’’
রেডিয়ো স্টেশনের অন্যতম পরিচালক চণ্ডীদাস মুখোপাধ্যায় বলেন, ‘‘কমিউনিটি রেডিয়ো ব্যাপারটা এলাকার নিজস্ব। সেখানকার মানুষের কথা ভেবেই অনুষ্ঠান হয়। পরিচালনাও করেন স্থানীয় লোকজন।’’ এ বার বর্ষার বেয়াড়াপনায় চাষিরা পড়েছেন বিপাকে। কাজের ফাঁকে রেডিয়ো থেকে জানতে পারছেন, কী ভাবে শস্য বিমা পেতে পারেন। ‘লিখতে জানে, পড়তে জানে, খেজুরগাছে চড়তে জানে’ যারা, তাদের চচ্চড়ি রান্নার কায়দাকানুনও শিখিয়ে দেন নিত্যানন্দ জনবাণী রেডিয়োর ‘জকি’। মোবাইল নম্বরে ফোন করে যোগাযোগ করা যায় জনবাণী রেডিয়োর সঙ্গে।
পুরুলিয়ায় এমন অনেক গ্রাম রয়েছে, যেখানে ইন্টারনেট এখনও সেঁধিয়ে যেতে পারেনি। টিভিও নেই। সেই সমস্ত এলাকার অনেক মানুষ রেডিয়োয় কান পেতে বসে থাকেন। প্রত্যন্ত এলাকায় ছড়িয়ে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে বাইরের দিকেও পা ফেলার ভাবনা কেন? ইউনিসেফের পুরুলিয়া জেলা শাখার প্রতিনিধি বিকাশরঞ্জন চক্রবর্তী জানান, আদিবাসী জনগোষ্ঠীর মধ্যে পুঞ্চার এই রেডিয়ো স্টেশনের শ্রোতার সংখ্যা বেড়ে চলেছে। সেই সূত্রেই সম্প্রচারের পরিধি বাড়ানোর কথা ভাবা হয়।
১৯৬১ সালের জনগণনায় পুরুলিয়ায় সাঁওতালি ভাষাভাষী ছিলেন মোট জনসংখ্যার ১০ শতাংশ। ২০০১ সালে দেখা যায়, সেটা বেড়ে হয়েছে ১১.৪ শতাংশ। জেলার মাটিতে এই ভাষা ও সংস্কৃতির শিকড়ের জোর যাতে আরও বাড়ে, সে জন্য নিত্যানন্দ জনবাণী রেডিয়ো কাজ করে চলেছে বলে দাবি চণ্ডীদাসবাবুর। তিনি বলেন, ‘‘সাঁওতালি এবং কুড়মালি ভাষায় আমাদের নিজস্ব অনুষ্ঠান রয়েছে।’’
প্রযুক্তির জোরে এ বার পুঞ্চার শিল্পীর ঝুমুর বেজে উঠবে উত্তরবঙ্গের কারও কম্পিউটারে। যেমন বাজছে কর্মসূত্রে ঝাড়খণ্ডের সরাইকেলায় থাকা মানবাজারের জনড়া গ্রামের বিশ্ববিকাশ রায় মাহাতোর মোবাইল ফোনে। তাঁর কথায়, ‘‘কুড়মালিতে প্রথম বার অনুষ্ঠান শুনতে শুনতে মনে হচ্ছিল, বাড়ির সেই কালো রেডিয়ো সেটটা কে যেন টেবিলে এনে রেখে দিয়েছে।’’