‘‘এত দিনে আমার মেয়েটা সুবিচার পেল। এই চার জনের ফাঁসি হলে তা এ দেশের মেয়েদের সাহস জোগাবে।’’
সোমবার দিল্লির গণধর্ষণ-কাণ্ডে চার আসামির ফাঁসির দিনক্ষণ তৃতীয় বারের জন্য পিছিয়ে গিয়েছে। তবে প্রথম বার ফাঁসির দিন ঘোষণা হওয়ার পরে দিল্লির আদালত চত্বরে দাঁড়িয়ে উপরের কথাগুলো বলেছিলেন নির্যাতিতার মা আশা সিংহ। জানিয়েছিলেন, সুবিচারের আশায় কী ভাবে দিনের পর দিন আদালতের দরজায় দরজায় ঘুরেছেন তাঁরা। বলেছিলেন, ‘‘এই রায় বিচার ব্যবস্থার প্রতি মানুষের আস্থা ফিরিয়ে আনবে।’’
আশাদেবী সে দিন যা বলেছিলেন, সেটাই কি বাস্তব?
নির্যাতনের শিকার হওয়া মহিলা বা তাঁদের পরিজনদের কাছে এই ফাঁসির রায় অবশ্য তেমন কোনও সুখবর বয়ে আনেনি। দিল্লিতে চার অপরাধীর ফাঁসি হলেও যে দেশে নারী-নিগ্রহের ছবিটা বদলাবে, এমন আশাও তাঁদের নেই। কেউ বলছেন, ‘‘দিল্লির মতো মর্মান্তিক ঘটনাতেও বারবার পিছিয়ে যাচ্ছে ফাঁসির দিনক্ষণ। এর পরে ফাঁসি যদি হয়ও, তাতে আমাদের জীবনে কিছু বদলাবে বলে মনে হয় না।’’ কেউ ক্ষোভের সুরে বলছেন, ‘‘বারবার ফাঁসি পিছিয়ে যাওয়ায় রীতিমতো হতাশ হচ্ছি। সাত বছর পরেও তো সুবিচার পাওয়া যাচ্ছে না। বাকিরা তা হলে কী আশা করবেন!’’
২০১২ সালের ওই ঘটনা বদলে দিয়েছিল দেশের নারী নিগ্রহ-বিরোধী আইন। শুধু রাজধানীতেই নয়, প্রতিটি রাজ্যেই নারী-নিরাপত্তায় জোর দিতে বাধ্য হয়েছিল সরকার। তবে তার পরেও কমেনি নির্যাতনের ঘটনা। ‘ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ড বুরো’ (এনসিআরবি)-র সাম্প্রতিক রিপোর্ট অনুযায়ী, ২০১৮ সালে মহিলাদের উপরে অ্যাসিড হামলার নিরিখে দেশে শীর্ষে রয়েছে পশ্চিমবঙ্গ। অবাধে অ্যাসিড বিক্রি এবং অপরাধীদের সাজা না হওয়ায় দিনদিন বাড়ছে হামলার ঘটনা। হতাশা বাড়ছে আক্রান্তদের মধ্যেও। ২০১৫ সালে অ্যাসিড হামলার শিকার, জয়নগরের মনীষা পৈলান বলছেন, ‘‘দিল্লির ঘটনার ক্ষেত্রেও বিচার পেতে সাত বছর পেরিয়ে যাচ্ছে, তা হলে আমরা কবে পাব? আদৌ পাব কি? আর কত দিন এ ভাবে কোর্টে দৌড়ব?’’ বছর ছাব্বিশের মনীষার প্রশ্ন, ‘‘বাংলাদেশ অ্যাসিড হামলা রুখে দিতে পারলে আমরা কেন নয়? অ্যাসিড মেরেও অভিযুক্ত বুক ফুলিয়ে ঘুরে বেড়ায় বলেই তো আরও পাঁচ জন তাকে দেখে অনুপ্রাণিত হয়! অপরাধীদের মনে ভয় ধরাতে আরও দ্রুত শাস্তি দেওয়া দরকার।’’
দিল্লির ঘটনার পরে দেশ জুড়ে প্রতিবাদের সময় থেকে কী ভাবে আস্তে আস্তে খবরে উঠে এসেছিল অ্যাসিড-আক্রান্তদের মর্মান্তিক কাহিনি, ‘ছপাক’ সিনেমার শুরুতেই তা দেখিয়েছেন পরিচালক মেঘনা গুলজার। সেই গণধর্ষণ-মামলায় দোষীদের ফাঁসি হলে কি অ্যাসিড-আক্রান্তদের লড়াইয়ে তার প্রভাব ফেলবে? মেঘনা বলছেন, ‘‘অ্যাসিড-আক্রান্তদের লড়াইটা শুধু অপরাধীদের সাজা দেওয়া নয়। কী ভাবে এই অপরাধ বন্ধ করা যায়, তা-ও লড়াইয়ের অংশ। আইন কঠোর হলেও অপরাধ হয়ে চলেছে। তবে দিল্লিতে ‘ছপাক’-এর প্রথম স্ক্রিনিংয়ের দিনই নির্ভয়ার অপরাধীদের ফাঁসির দিন ঘোষণা হয়েছিল। মনে হয়, এই দুইয়ের একটা যোগ রয়েছে। আমি আশাবাদী।’’
সোনারপুরের খোকন দাস অবশ্য আশার আলো দেখছেন না। ২০১৬-র ১১ অক্টোবর শ্বশুরবাড়ি থেকে বোন মিতার মৃত্যুর খবর এসেছিল। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের প্রাক্তনী মিতাকে শ্বশুরবাড়িতে নিগ্রহ এবং খুনের অভিযোগ দায়ের করেন খোকন ও তাঁর পরিবার। তবে সাড়ে তিন বছরেও ‘সুবিচার’ পাননি তাঁরা। সিআইডি চার্জশিট দিলেও বিচার প্রক্রিয়া বিলম্বিত হচ্ছে বলে অভিযোগ। তাই দিল্লির অপরাধীদের ফাঁসিতে এ দেশে নারী-নিগ্রহের ছবি বদলাবে বলে মনে করেন না তিনি। বিচার ব্যবস্থার প্রতি ক্রমশ আস্থা হারাতে বসা খোকন বলছেন, ‘‘প্রতিদিনই কত নিগ্রহের ঘটনা ঘটছে, কিন্তু ক’টা শাস্তির খবর হয় বলুন তো! দিল্লির ঘটনাতেই সাত বছর পেরনোর পরেও তো শাস্তি হচ্ছে না।’’
আশাদেবীর মতো নিজেদের অধিকার রক্ষায় মাটি কামড়ে পড়ে থেকেছেন এ দেশের রূপান্তরকামীরাও। সুপ্রিম কোর্টে ‘অসাংবিধানিক’ ৩৭৭ ধারা রদের পরে এখনও তাঁরা লড়ছেন সমাজের গোঁড়ামির বিরুদ্ধে। তবে দিল্লিতে ফাঁসির খবর তাঁদের মতো প্রান্তিক মানুষদের চোয়াল শক্ত করবে বলেই মনে করেন রূপান্তরকামী নারী মেঘ সায়ন্তন ঘোষ। পেশায় আইনজীবী মেঘ সায়ন্তন বললেন, ‘‘লাঞ্ছনা-গঞ্জনা নয়, নারী বা পুরুষের স্বীকৃতি চাই আমরা। তবে সময় লাগবে। অপরাধীকে শাস্তি দিলেই যে মানুষের মানসিকতা বদলাবে, তা নয়। তবে এটা মানসিকতা বদলের প্রাথমিক ধাপ বলে ধরা যায়। বিপ্লবও তো এক দিনে আসে না!’’