একগুচ্ছ মেয়র পারিষদ রয়েছেন। মেয়র শোভন চট্টোপাধ্যায় নিজেও একাধিক দফতর দেখাশোনা করেন। তার পরেও নিজের হাতে থাকা তথ্যপ্রযুক্তি বিভাগের পরামর্শদাতা হিসেবে দলের এক নবীন কাউন্সিলরকে নিয়োগ করেছেন মেয়র। এই নিয়োগ কেন্দ্র করেই কলকাতা পুরসভাতেও তৃণমূল দলের কাউন্সিলরদের ‘পাইয়ে দেওয়ার রাজনীতি’ করছে বলে বিতর্ক শুরু হয়েছে।
কোনও বিজ্ঞপ্তি জারি বা ঘোষণা ছাড়াই সপ্তাহখানেক আগে তৃণমূল বিধায়ক স্বর্ণকমল সাহার ছেলে তথা ৫২ নম্বর ওয়ার্ডের তৃণমূল কাউন্সিলর সন্দীপন সাহাকে পুরসভার তথ্যপ্রযুক্তি বিভাগের পরামর্শদাতার দায়িত্বে বসিয়েছেন মেয়র। তথ্যপ্রযুক্তি বিভাগের দায়িত্বে রয়েছেন মেয়রই। তার পরেও আলাদা করে কেন এক জন কাউন্সিলরকে আবার ওই দফতরের পরামর্শদাতা করা হল, তা নিয়ে সরব হয়েছেন বিরোধীরা।
চলতি মাসেই রাজ্যের একগুচ্ছ পরিষদীয় সচিবের নিয়োগকে অবৈধ বলে রায় দিয়েছে কলকাতা হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতির ডিভিশন বেঞ্চ। পরিষদীয় সচিব নিয়োগ নিয়ে বিরোধীরা গোড়া থেকেই সরব ছিল। তাদের অভিযোগ ছিল, সংবিধান অনুযায়ী মন্ত্রীর সংখ্যা নির্দিষ্ট। অথচ তৃণমূলে মন্ত্রিপদ প্রত্যাশীর সংখ্যা কম নয়। এই অবস্থায় বিক্ষুব্ধদের শান্ত রাখতেই নিয়ম ভেঙে পরিষদীয় সচিব পদটি তৈরি করেছে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার। এটা অসাংবিধানিক। রায় দিতে গিয়ে বিচারপতিরাও একে অসাংবিধানিক বলেই মন্তব্য করেছিলেন। বিরোধীদের অভিযোগ, পুরসভাতেও মেয়র পারিষদের সংখ্যা নির্দিষ্ট। মেয়র পারিষদের বাইরে থাকা অন্য কাউন্সিলরদের ক্ষোভ সামাল ও বাড়তি ক্ষমতা দিতেই সন্দীপনকে মেয়রের দফতরের পরামর্শদাতা করা হয়েছে বলে বিরোধীদের অভিযোগ।
মেয়র পারিষদের ‘কোটা’ শেষ বলেই যে সন্দীপনকে পরামর্শদাতা পদটি দেওয়া হয়েছে, তা কার্যত মেনে নিয়েছেন মেয়র নিজেও! সন্দীপনের নিয়োগ প্রসঙ্গে মেয়রের ব্যাখ্যা, ‘‘সন্দীপন জোকা আইআইএমের স্নাতক। ছোটভাইয়ের মতো। তথ্যপ্রযুক্তি বিভাগে ওর দক্ষতাকে কাজে লাগাতেই এই দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। ও আমাকে গাইড করবে।’’ তা হলে সন্দীপনকে এই দফতরের মেয়র পারিষদ করা হল না কেন? মেয়রের জবাব, ‘‘মেয়র পারিষদের কোটা তো শেষ!’’
বিরোধীদের অবশ্য বক্তব্য, দক্ষতা নয়, আসেল বাড়তি সুবিধা পাইয়ে দিতেই এই ধরনের পদ তৈরি করা হয়েছে। একই সঙ্গে তাঁদের আশঙ্কা, আগামী দিনে এ ধরনের আরও অনেক পরামর্শদাতার পদ তৈরি করা হবে। প্রবীণ কংগ্রেস কাউন্সিলর প্রকাশ উপাধ্যায়ের আশঙ্কা, মেয়র পারিষদের সমগ্রোত্রীয় এই পদটি তৈরি করে কিছু লোককে মেয়র পারিষদদের সমান সুযোগ-সুবিধা দেওয়া হবে। এবং এ ভাবেই আমজনতার টাকা নয়ছয় করা হবে। পাশাপাশি, সন্দীপনকে যে এই দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে, তা পুর-প্রতিনিধিদের জানানোই হয়নি। এই ঘটনাকে ‘অনৈতিক’ বলে দাবি করে প্রকাশবাবু বলেন, ‘‘কলকাতা পুরসভার ইতিহাসে এমন ঘটনা ঘটেনি! এমন হলে তো প্রত্যেক দফতরেই আলাদা করে পরামর্শদাতা রাখা শুরু হবে! মেয়র পারিষদ করতে পারেনি, তাই স্রেফ পাইয়ে দেওয়ার রাজনীতি করতেই এমন দায়িত্ব দেওয়া হল।’’ তাঁর বক্তব্য, ‘‘মেয়র পারিষদের বাইরে কোনও কাউন্সিলরকে কোনও দফতরের দায়িত্ব দেওয়া হলে পুরসভার সব প্রতিনিধিকে তা জানাতে হয়। আইনও পাশ করাতে হয় পুরসভায়। কিন্তু কিছুই জানানো হয়নি আমাদের।’’ এ নিয়ে আগামী মাসে বাজেট অধিবেশনে তাঁরা সরব হবেন। বিজেপি কাউন্সিলর বিজয় ওঝাও বলেন, ‘‘ঘটনাটা জানিই না। এমন যদি হয়ে থাকে, তা হলে বলব এত লুকোচুরির কী রয়েছে!’’ সিপিএম কাউন্সিলর রত্না রায় মজুমদার বিষয়টি জানেন না বলে মন্তব্যই করতে চাননি।
নয়া পরামর্শদাতার জন্য আলাদা ঘর বরাদ্দ করা হবে বলে পুরসভা সূত্রের খবর। এমনকী, তাঁকে বাড়তি সুযোগ-সুবিধা দেওয়া নিয়ে ভাবনা-চিন্তা হয়েছে বলে স্বীকার করেছেন মেয়র। তাঁর কথায়, ‘‘এই দফতরের কাজে তো বহু টাকা খরচ হচ্ছে। সন্দীপন শিক্ষিত ছেলে। ওর দক্ষতা কাজে লাগাতেই ওকে পরামর্শদাতা করা হয়েছে। ফলে ওকে কিছু সুযোগ-সুবিধা তো দিতেই হবে।’’ যদিও সেই সুবিধা কী, তা নিয়ে প্রকাশ্যে মন্তব্য করতে চাননি তিনি।
তথ্যপ্রযুক্তি সেক্টরে দেশবিদেশের বহুজাতিক সংস্থায় চাকরি করেছেন সন্দীপন। রাজনীতির আকর্ষণে চাকরি ছেড়ে এ বছরই পুরভোটে প্রথমবার তৃণমূলের প্রার্থী হন। ইতিমধ্যেই তথ্যপ্রযুক্তি দফতরের পরামর্শদাতা হিসেবে কাজ শুরু করে দিয়েছেন তিনি। লিখিত ভাবে দায়িত্বের কথা তাঁকে অবশ্য পুরসভার তরফে এখনও জানানো হয়নি। সন্দীপনের কথায়, ‘‘মেয়র মৌখিক ভাবে আমাকে ওই দফতরের পরামর্শদাতা হিসেবে কাজ করার কথা বলেছিলেন। আমি কাজ শুরুও করেছি। আপাতত তথ্যপ্রযুক্তি দফতরে বসেই কাজ করছি।’’ তিনি বলেন, ‘‘তথ্যপ্রযুক্তি সেক্টরে কাজ করেছি। এখন পুরসভায় ই-সার্ভিসের উপর মেয়র জোর দিতে চাইছেন বলেই আমার দক্ষতাকে ব্যবহার করতে চাইছেন বলে আমার মনে হয়।’’