একটি মোটরবাইক বিস্ফোরণের ঘটনার তদন্তে ‘গাফলতি’র জন্য সরিয়ে দেওয়া হল খয়রাশোলের ওসি দেবব্রত সিংহকে। শুধু খয়রাশোল থানার দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দেওয়াই নয়, জেলার কোনও থানার দায়িত্ব ওই পুলিশ আধিকারিকের উপর না দিয়ে তাঁকে শাস্তিই দেওয়া হয়েছে বলে স্বীকার করে নিয়েছেন জেলা পুলিশের শীর্ষ কর্তা। জেলার পুলিশ সুপার অলোক রাজোরিয়া বলেন, “ওসিকে শাস্তি দেওয়ার পিছনে বিস্ফোরণকাণ্ড অন্যতম কারণ। এ ছাড়াও বিভাগীয় অন্য কয়েকটি কারণও রয়েছে।” তবে সেগুলি কী স্পষ্ট করেননি এসপি।
প্রসঙ্গত, গত ৬ মার্চ রাতে খয়রাশোলের ভাদুলিয়ায় একটি বাইক বিস্ফোরণ হয়েছিল। ওই ঘটনায় ওসির ভূমিকায় মোটেই সন্তুষ্ট ছিলেন না পুলিশ সুপার। ঠিক কী ঘটেছিল ওই দিন, বাইকের সিটের তলায় রাখা ডিটোনেটর বিস্ফোরণে মৃত্যু হয়েছিল গৌতম ভাঁড়ারী (৩১) নামে এক যুবকের। বিস্ফোরণের তীব্রতা এতটাই ছিল যে, কোমরের নীচের অংশ ছিন্নভিন্ন হয়ে গিয়ে ঘটনাস্থলেই মৃত্যু হয় ভাদুলিয়া গ্রামের ওই বাসিন্দার। ক্ষতিগ্রস্থ হয় বাইকটিও। এসপি ওই দিন জানিয়েছিলেন, বিষয়টিকে অত্যন্ত গুরুত্ব সহকারে নেওয়া হচ্ছে কেন? কী ভাবে ওই যুবকের বাইকে বিস্ফোরক এল? বিস্ফোরণের অভিঘাত কেন এত বেশি হল? এর সঙ্গে মৃত যুবকের যোগ কতটা বা এর সঙ্গে মাওবাদী যোগ আছে কি না সবটাই খতিয়ে দেখা হচ্ছে। ঘটনাস্থল থকে নমুনা সংগ্রহ করে ফরেন্সিক পরীক্ষার জন্য পাঠানো হচ্ছে।
অবশ্য পুলিশ সুপারের একথা বলার পেছনে সঙ্গত কারণও ছিল। অতীতে খয়রাশোলে রেল লাইন বা বেসরকারি মোবাইল সংস্থার বেস স্টেশন উড়িয়ে দেওয়ার মতো একাধিক নাশকতায় যেখানে মাওবাদী যোগ পাওয়া গিয়েছে। শুধু তাই নয়, ২০১০ সালের ৯ মার্চ অনুরূপ একটি বিস্ফোরণের ঘটনায় মিঠু দাস নামে এক তরুণীর দেহ ছিন্নভিন্ন হয়ে যায়। পুলিশ সূত্র অনুযায়ী, একই ভাবে বাইকের টুলবক্সে রাখা বিস্ফোরণে মিঠুর মৃত্যুর পাশাপাশি শেখ জাফর নামে এক ব্যক্তি জখম হয়েছিলেন। আরও উল্লেখযোগ্য, মিঠুর বাড়িও ছিল ভাদুলিয়া গ্রামে। সে সময়ে খয়রাশোলে যেহেতু মাওবাদীদের উপস্থিতি ও একাধিক নাশকাতার ঘটনায় মাওবাদী যোগ ছিল বলে পুলিশ দাবি করেছিল, তাই ওই ঘটনার তদন্তে এসেছিলেন তৎকালিন ডিআইজি শ্রী জগমোহন এবং পরে আইজি পশ্চিমাঞ্চল জুলফিকার হোসেন। স্বাভাবতই ভাদুলিয়ার বিষয়টি হালকা নেওয়ার পক্ষপাতি ছিলেন না পুলিশ সুপার।
অথচ খয়রাশোলের সদ্যপ্রাক্তন ওসি বিস্ফোরণে ক্ষতিগ্রস্ত বাইকটির অংশ বিশেষ ও ঘটনাস্থল থেকে সংগৃহীত নমুনা সেন্ট্রাল ফরেন্সিক সায়েন্স ল্যাবে বা ডাইরেক্টোরেট জেনারেল অফ মাইনস সেফটি পাঠানো বা ঘটনার উপযুক্ত তদন্ত করা কোনওটিই সঠিক ভবে করেনি বলে পুলিশ সূত্রে জানা গিয়েছে। পুলিশের তরফে আরও দাবি করা হয়েছে, এর পরই খয়রাশোলে তৃণমূল নেতা অশোক মুখোপাধ্যায় খুনের পর ব্যস্ত হয়ে ওঠায় বিক্ষোরণের বিষয়টি নিয়ে তেমন গুরুত্ব দেননি বা প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেননি ওসি। তাতেই চটে যান পুলিশ সুপার।
তবে এর প্রধান কারণ বর্তামানের প্রেক্ষিত বলে মনে করা হচ্ছে। যখন বর্ধমানের খাগরাগড় বিস্ফোরণের পর তোলপাড় গোটা রাজ্য। এনআইএ তদন্তের দায়িত্ব নিয়েছে। প্রায় তখনই পাণ্ডবেশ্বর এলাকায় তৃণমূল নেতার বাইকে বিস্ফোরণ ঘটে যাওয়ায় খয়রাশোলের ভাদুলিয়া কাণ্ডও সামনে আসে। তাই এই পদক্ষেপ বলেও জানা গিয়েছে। যদিও পুলিশ মহল ও স্থানীয় সূত্র অনুযায়ী, খয়রাশোলে একটি বেসরকারি সংস্থার দু’টি খোলা মুখ কয়লা খনি থাকলেও বহুকাল ধরে খয়রাশোলে অবৈধ কয়লা খাদানে বিস্ফোরণ করিয়ে সেই কয়লা তোলার ঘটনা নতুন নয়। তাই ডিটোনেটরের মতো বিস্ফোরণের কারবারে যুক্ত এলাকার কেউ কেউ একথা অজানা থাকার কথাও নয় পুলিশ কর্তাদের। ফলে ওসিকে সরিয়ে দেওয়ার পেছনে যে অন্য কারণের কথা এসপি বলেছেন, সেগুলি নিয়েও গুঞ্জন চলছে।
কেউ কেউ এও দাবি করেছেন, “খয়রাশোল থেকে প্রতি রাতে কয়েক ট্রাক কয়লা পাচারে মদত দেওয়ার পাশাপাশি বর্তমানে (অশোক ঘোষ ও অশোক মুখোপাধ্যায় খুন হওয়ার পরবর্তী পরিস্থিতিতে) খয়রাশোলে তৃণমূলের নেতৃত্বহীনতার সুযোগে দেবব্রতবাবুর অনৈতিক কাজ করার বিরুদ্ধে সরব হয়েছিল তৃণমূলের একটি অংশ। কারণ, তৃণমূলের জেলা সহসভাপতি মলয় মুখোপাধ্যায় সম্প্রতি খয়রাশোল থেকে তৃণমূলের ছয় নেতা কর্মীকে আগ্নেয়াস্ত্র-সহ গ্রেফতার করার পর পুলিশ রাজনীতি করছে বলেও অভিযোগ তুলেছিলেন।” ওসিকে বদলের পেছনে তেমন অন্য করাণও থাকতে পারে বলে মনে করছেন কেউ কেউ। এ প্রসঙ্গে যদিও দেবব্রত সিংহ একটি কথাও বলতে রাজি হননি।