রামায়ণের পট হাতে শিল্পী সেরামুদ্দিন চিত্রকর। —নিজস্ব চিত্র।
কাজের কথায় ছিলেন। তাই ‘মনের কথা’ শোনার সময় পাননি। জানতে পারেননি প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী রবিবার রেডিয়োয় ‘মন কি বাত’ অনুষ্ঠানে তাঁর আঁকা রামায়ণ পটের উল্লেখ করেছেন।
বিকেলে সাংবাদিকদের থেকে খবরটা পান সেরামুদ্দিন চিত্রকর। পশ্চিম মেদিনীপুরের পিংলার পটুয়াদের গ্রাম নয়ার পটশিল্পী সেরামুদ্দিন। এখন কলকাতায় হস্তশিল্প মেলায় গিয়েছেন। মেলা প্রাঙ্গণ থেকেই ফোনে সেরামুদ্দিন বললেন, ‘‘চারটি রামায়ণের পট এঁকেছিলাম। তিনটি বিক্রি হয়েছে।’’
সেরামুদ্দিনের ছবির সঙ্গে যোগ রয়েছে ‘ইনক্রেডিবল ইন্ডিয়া’র ‘উইকএন্ড গেটওয়ে’ নামে এক কর্মসূচির। ‘মন কি বাত’-এ মোদী এর উল্লেখও করেছেন। এই কর্মসূচির সঙ্গে যুক্ত ছিল পশ্চিম মেদিনীপুরের পটের গ্রাম নয়া আর মাদুরের গ্রাম সবংয়ের সার্তা। নয়ায় ৩১ ডিসেম্বর থেকে ২ জানুয়ারি কর্মসূচি হয়। সেখানেই বিক্রি হয় সেরামুদ্দিনের পট। প্রধানমন্ত্রী এক ভিডিয়ো থেকে জানতে পারেন দু’লক্ষ টাকায় রামায়ণের পট বিক্রির কথা। অবশ্য এই পটটি নিয়ে একটু বিপাকে পড়েছেন সেরামুদ্দিন। ৩০ ফুট লম্বা আর ৩ ফুট চওড়া রামায়ণের পটটি বিক্রি হয়েছিল ঠিকই। ক্রেতা অগ্রিমও দিয়ে গিয়েছিলেন। কিন্তু রাখার জায়গা না থাকায় সেই পট তিনি ফেরত দিয়ে একটু ছোট আকারের পট নিয়ে যান। এই পটটি রাবণ বধের উপরে আঁকা। সেরামুদ্দিন বললেন, ‘‘খুব খুশি হতাম যদি এটাও বিক্রি হয়ে যেত।’’
শিল্পকর্ম বিক্রি হওয়াটাই এখন সেরামুদ্দিনের কাছে গুরুত্বপূর্ণ। বলা ভাল, গোটা পটুয়া পাড়ার কাছেই। করোনাভাইরাসের কারণে ২০২০-র প্রায় পুরোটাই কেটেছে ঘরে বসে। রেশনের চাল আর জমানো অল্প কিছু টাকাই সম্বল ছিল বেশিরভাগ পটুয়ার। আশঙ্কার মেঘ এখনও পুরো কেটেছে বলতে পারেন না সেরামুদ্দিনরা। হস্থশিল্প মেলায় টুকটাক বিক্রি হচ্ছে। স্টল নেই। পট নিয়ে বসতে হচ্ছে খোলা মাঠে। সন্ধ্যার পরে শিশিরে ক্ষতি হতে পারে পটের। তাই তাড়াতাড়ি গুটিয়ে ফেলতে হচ্ছে বিকিকিনির পাট। তবুও প্রধানমন্ত্রীর স্বীকৃতি সংশয়ের মধ্যে খুশি আনে শিল্পীর মনে।
সেই প্রশংসায় অবশ্য রাজনীতি দেখছে তৃণমূল। তাদের অভিযোগ, সংখ্যালঘু শিল্পীর আঁকা রামায়ণের পট ভোট-বঙ্গে কৌশলী ভাবেই সামনে আনছেন মোদী। জেলা তৃণমুল সভাপতি অজিত মাইতি সোজাসাপটা বললেন, ‘‘ভোটের আগে রাজনীতি করছেন প্রধানমন্ত্রী।’’ বিজেপির জেলা সভাপতি শমিত দাসের পাল্টা প্রশ্ন, ‘‘ভোটের আগে ভাল কিছু করা যাবে না এরকম নিয়ম আছে নাকি? এক সংখ্যালঘু শিল্পী রামায়ণ নিয়ে পট আঁকছেন, তা প্রধানমন্ত্রীরও ভাল লেগেছে। উনি সেই কথাই বলেছেন।’’
ভিন্ ধর্মী পটুয়াদের হিন্দু পুরাণ, মহাকাব্য নিয়ে পট আঁকা অবশ্য নতুন নয়। পটুয়াদের ধর্ম নিয়ে মাথা ঘামানোর রেওয়াজ নেই সেই সুলতানি আমল থেকেই। ঘটনাচক্রে পটুয়াদের বেশিরভাগই ধর্মে মুসলিম। প্রধানমন্ত্রীর কাছেও পিংলার পট নতুন নয়। গত ২৩ জানুয়ারি নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর জন্মদিবস পালনে জাতীয় গ্রন্থাগারের অনুষ্ঠানে আট পটুয়ার সঙ্গে সাক্ষাৎ হয় মোদীর। পিংলার এই পটুয়ারা নেতাজির জীবন বিষয়ক পট আঁকার দায়িত্ব পেয়েছিলেন। সেখানে পটুয়াদের কাছে মোদী পটের বিষয়ে জানতেও চেয়েছিলেন।
রাজনীতির জটে অবশ্য ঢুকতে নারাজ সেরামুদ্দিন। তাঁর সোজা কথা, ‘‘আমি শিল্পী। আমার বক্তব্য আমার আঁকা পটের মধ্যে দিয়েই তো বলি। প্রধানমন্ত্রী নয়ার পটুয়াদের স্বীকৃতি জানিয়েছেন, তাতেই আমি খুশি। পটটা বিক্রি হলে আরও খুশি হব।’’