এখন অঞ্জনা। —নিজস্ব চিত্র।
সেই কবেকার কথা। ধনপতি সদাগর সিংহল যাত্রার সময় ‘নয় দীয়ার’ নদীতীরে রাত্রিবাস করার সময়ে প্রাচীন এই জনপদের মানুষের মুখেই শুনেছিলেন তাঁদের এক প্রিয় নদী অলকানন্দাকে হারিয়ে ফেলার গল্প। জেনেছিলেন একবার নদী হারানোর বেদনা থেকে কেমন করে নদীকে সন্তানের মতো স্নেহে লালন করার ইচ্ছার জন্ম হয়েছিল নদিয়াবাসীর মনে। আরও শুনেছিলেন সংখ্যাহীন নদীস্রোত থেকেই কী ভাবে এই জায়গার নাম নদিয়া হয়েছিল। নদিয়ার নামকরণ নিয়ে যতই তর্ক থাক, এ কথা সত্যি যে, ষোড়োশ শতকের শেষ দিকে কবিকঙ্কন মুকুন্দরাম যখন চণ্ডীমঙ্গল লিখছেন তখন থেকেই এখানকার নদীদের হারিয়ে যাওয়া শুরু হয়ে গিয়েছে। সেকালের বর্ধিষ্ণু নগর নদিয়ার অলকানন্দা কী ভাবে হারিয়েছিল তা অবশ্য জানতে পারেননি ধনপতি। কিন্তু জেনেছিলেন কী ভাবে মানুষ যত্নবান হয়েছিলেন জলঙ্গি অঞ্জনা ইছামতি বা চুর্ণিকে বেঁধে রাখতে। নদিয়ার পাশেই বর্ধমানের দামুন্যা গ্রামের বাসিন্দা মুকুন্দরামের বাড়িও ছিল এক নদীর পাড়ে। রত্না নদী। তাঁর মঙ্গলকাব্য এত নদীময় হয়তো সেই কারণেই।
যে যে নদীর কথা কবিকঙ্কনের চন্ডীমঙ্গলের ‘বনিক খণ্ড’ অনুসরণে লিখিত উপন্যাস ‘ধনপতির সিংহলযাত্রা’য় উল্লিখিত হয়েছে সেই সব নদীর বেশির ভাগই হয় হারিয়ে গিয়েছে, নয়তো হারানোর পথে। অলকানন্দা হারিয়েছিল সেই আমলেই। তারপর একে একে হারিয়ে গেছে অঞ্জনা, গুড়গুড়ে। মৃত্যুর দিন গুনছে পাগলাচন্ডী, জলঙ্গি, চুর্ণি বা ইছামতি।
নদী বিশেষজ্ঞ কল্যাণ রুদ্রের অভিমত, দ্বাদশ শতাব্দী থেকে ষোড়শ শতাব্দীর মধ্যে এই জনপদের প্রধান নদী গঙ্গার প্রবাহপথের আমূল পরিবর্তন ঘটে। গঙ্গা কোন পথে বঙ্গোপসাগরের দিকে প্রবাহিত হতে শুরু করেছিল সে নিয়ে বিশেষজ্ঞদের মধ্যে মত পার্থক্য আছে। বিগত দু’শো বছর ধরে নানা লেখা রিপোর্ট ও আলোচনায় নদী বিশেষজ্ঞদের অনেকেই ভাগীরথী-হুগলী নদীকেই গঙ্গার প্রাচীন প্রবাহপথ বলে চিহ্নিত করেছেন। কিন্তু কবে থেকে গঙ্গার জল ভাগীরথী খাত ছেড়ে পদ্মার খাতে বইতে শুরু করেছিল, সে ব্যাপারেও নানা মত। তবে সাধারণ ভাবে মনে করা হয়, এটা একদিনে হয়নি। ওই বারো থেকে ষোড়শ শতাব্দীর মধ্যবর্তী সময় ধরে একটু একটু করে গঙ্গার জল ভাগীরথী থেকে পদ্মার খাতে চলে গিয়েছিল। এই পরিবর্তনের সময় ভৈরব, জলঙ্গি, মাথাভাঙা, গড়াই প্রভৃতি নদী কিছু সময়ের জন্য সক্রিয় হয়ে আবার মজে গেছে। মুকুন্দরাম চন্ডীমঙ্গল লিখেছেন ওই ষোড়শ শতাব্দীতেই। অর্থাৎ গঙ্গার ভাঙচুর যখন তুঙ্গ পর্যায়ে। নদীপাড়ের মানুষ হিসেবে তিনি সহজেই বুঝতে পেরেছিলেন প্রধান নদীর এই ধারাবদল হয়ত আরও অনেক নদীর মৃত্যুর কারণ হবে। তাঁর সে আশঙ্কা যে অমূলক ছিল না, তার প্রমাণ পরবর্তী সময়ে বারবার মিলেছে।
সময়টা ১৫১০। চৈতন্যদেব তাঁর সন্ন্যাসগ্রহণের বারো দিন পর ফিরে এসেছেন নদিয়ার শান্তিপুরে। নবদ্বীপ থেকে দলে দলে লোক ঘাট পার হয়ে ছুটছে সেখানে। এত ভিড়, যারা নৌকো পাচ্ছেন না, তাঁরা সাঁতরে নদী পার হচ্ছেন। কৃষ্ণদাস কবিরাজ সে দৃশ্য বর্ণনা করতে গিয়ে লিখছেন,
“অনন্ত অর্বুদ লোক হৈল খেয়াঘাটে
খেয়ারি করিতে পার পড়িল সংকটে
কেহ বান্ধে ভেলা, কেহ ঘট বুকে করে
কেহ বা কলার গাছ ধরিয়া সাঁতরে।”
কিন্তু প্রশ্ন হল এ কোন নদী-গঙ্গা? ভাগীরথী? অথচ ১৬৬০ সালের ভ্যানডেন ব্রুকের মানচিত্র বলছে সেই সময় গঙ্গা নবদ্বীপের পশ্চিম দিক দিয়ে প্রবাহিত হত। আর নবদ্বীপ এবং শান্তিপুর দু’টি জায়গাই ছিল নদীর পূর্বপাড়ে। তা হলে নবদ্বীপ থেকে শান্তিপুর যেতে গঙ্গা পার হওয়ার প্রশ্নই ওঠে না। তাহলে এ কোন নদী? গবেষকদের ধারণা, চৈতন্য সমকালীন সেই নদী আসলে জলঙ্গি। উৎস থেকে মোহনা সবটাই নদিয়া জেলার মধ্যে অবস্থিত। কৃষ্ণনগর গভর্নমেন্ট কলেজের ভূগোলের অধ্যাপক বলাইচন্দ্র দাস জলঙ্গি নিয়ে গবেষণা করছেন বেশ কয়েক বছর ধরে। তিনি বলেন, পাঁচশো বছরেরও বেশি প্রাচীন জলঙ্গি নদী মৃত্যুর দিন গুণছে। তার জন্য প্রাকৃতিক কারণ যেমন রয়েছে, তেমনই রয়েছে মানুষের লোভ, প্রশাসনের উদাসীনতা আর আমাদের ইতিহাস ভুলে থাকার স্বভাব বৈশিষ্ট্য। জলঙ্গির মূল দৈর্ঘ্যের ২২০.৫ কিমির মধ্যে ৪৮ কিমির আজ আর কোনও অস্তিত্বই নেই। কোথাও নদী এখন আবাদী জমি তো কোথাও রাজ্য সড়ক! বলাইবাবুর কথায়, “নদিয়ার ‘লাইফলাইন’ কিন্তু গঙ্গা নয়। জলঙ্গি। কেননা গোটা নদিয়ায় গঙ্গা আছে মাত্র কয়েক কিলোমিটার। সেখানে করিমপুরের উত্তর প্রান্তের চরমধুবোনা থেকে উৎপন্ন হয়ে জলঙ্গি নবদ্বীপের কাছে স্বরূপগঞ্জে গঙ্গায় মিশেছে। কিন্তু চরমধুবোনা থেকে মোক্তারপুর পর্যন্ত ৪৮ কিমি নদী হারিয়ে গেছে। বাকি ১৭২.৫ কিমির অবস্থাও বড় করুণ।”
হবে নাই বা কেন, ১৯৫৯ সালে জলঙ্গি-করিমপুর রোড তৈরির সময়ে সরকারি উদ্যোগে জলঙ্গি নদী বুজিয়ে দেওয়া হয়েছিল। তারপর কেউ নদীর বুকে মাটি ফেলে আবাদী জমি বাড়িয়ে নিয়েছেন। তেহট্টের এক ঘাট মালিক জানিয়েছেন, প্রতি শীতে তিনি ৭০ থেকে ৮০ লরি মাটি ফেলে নদীর দু’পাড়কে কাছে আনেন। তারপর নদীর বুকে খান চারেক নৌকো বেঁধে তার উপর তক্তা ফেলে গাড়ি চলাচলের ব্যবস্থা করেন। সর্বোপরি আছে মৎস্য সমবায়গুলি। যারা লিজের নামে নদী যেন কিনেই ফেলেছেন এমন মেজাজে নদীর বুকে বাঁধ দিয়ে ব্যবসা করছেন। সবাই এসবই জানেন। কিন্তু কোনও প্রতিকারের ব্যবস্থা কেউ করেন না। ফলে নদীরা এগিয়ে চলে মৃত্যুর দিকে।
আর একটু পরের কথা। সপ্তদশ শতকে জলঙ্গির একটি শাখা অঞ্জনা নামে কৃষ্ণনগরের কাছ থেকে বেড়িয়ে দোগাছিতে দু’টি ধারায় বিভক্ত হত। উত্তরের শাখাটি চিত্রশালী হয়ে হাঁসখালিতে চুর্ণিতে মিশত। যেটি হেলের খাল নামে পরিচিত। দক্ষিণ শাখাটি জয়পুর, ধর্মদহ, বাদকুল্লা, চন্দনদহ হয়ে ব্যাসপুরের কাছে চুর্ণিতে মিশেছে। দেওয়ান কার্তিকেয়চন্দ্র রায়ের ক্ষিতীশ বংশাবলী চরিত (১৮৫৭) বইতে অঞ্জনার কথা পাওয়া যায় বিশদ ভাবে। কল্যাণ রুদ্রের মতে, ১৬৮৪ সালে রাজা রুদ্র রায় নদীর উৎসমুখটি বন্ধ করে দেওয়ার পরে নদীটি মজে যায়।
এ কালেই বা প্রশাসন কী করছে? নদিয়ার জেলাশাসক পিবি সালিম বলেন, “হারিয়ে যাওয়া নদীগুলিকে পুনরুদ্ধারের জন্য আমরা সুজলা নদিয়া নামে একটি প্রকল্প হাতে নিয়েছি। তাতে অঞ্জনা এবং যমুনা এই দু’টি নদীকে প্রথমে বেছে নেওয়া হয়েছে।” তিনি জানান, নদিয়ায় অঞ্জনার ২৬ কিলোমিটার খাত রয়েছে। তার মধ্যে ১৬ কিলোমিটার গ্রামাঞ্চলে, বাকিটা পুর এলাকায়। গ্রামীণ এলাকার ৪ কিলোমিটারের পুনরুদ্ধারের কাজ একশো দিনের কাজের মাধ্যমে হয়ে গিয়েছে। বাকি ১১ কিলোমিটারের কাজ চলছে। হরিণঘাটার কাছে যমুনা নদী খাত সংস্কারের কাজও একশো দিনের কাজের মাধ্যমে শুরু হয়েছে। এরপর এক এক করে অন্য নদীগুলির সংস্কারের কাজও শুরু হবে।
গত দুই শতাব্দীতে দেশের নদী মানচিত্র অনেকটাই বদলে গিয়েছে। নদিয়া-মুর্শিদাবাদ অঞ্চলে হারিয়ে গেছে অনেক নদী। যেমন কুলকুলি। ১৭৭৯ সালে প্রকাশিত রেনেলের মানচিত্রে ভাগীরথী ও পদ্মার মধ্যে সংযোগ রক্ষাকারী গোবরা নালা আজ অবলুপ্ত। ইছামতি, ভৈরব, চুর্ণি এখন মরসুমি নদী। বর্ষার কয়েক মাস তাদের বেঁচে থাকা। কল্যাণবাবুর কথায়, ১৭৯৩ সালে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত চালু হওয়ার পর থেকে কৃষিজমির গুরুত্ব বাড়তে থাকে। শুরু হয় নদীর দু’পাড়ে বাঁধ নির্মাণ। ১৮৫৭-র সিপাহি বিদ্রোহের পর ইংরেজ শাসকেরা সেনা বাহিনীর দ্রুত যাতায়াতের জন্য রেলপথ নির্মাণ শুরু করেন। পাল্লা দিয়ে বাড়তে থাকল সড়ক পথের দৈর্ঘ্য। পরবর্তী কালে তার সঙ্গে যোগ হয়েছে নগরায়ন এবং লোভী মানুষের অপরিণামদর্শিতা।
পাঁচশো বছরেরও বেশি সময় ধরে নদিয়ার নদী হারানোর সেই ট্র্যাডিশন সমানে চলেছে।