ইফতার শুরুর আগে প্রার্থনা। ছবি: গৌতম প্রামাণিক
পেঁয়াজি-জিলিপি থেকে পেস্তা-কিশমিশ, আয়োজনে বাদ যায়নি কিছুই। হাজার খানেক নিমন্ত্রিতও এসেছিলেন। তবু খানিক পানসে হয়ে গেল হুমায়ুন কবীরের ইফতারের ভোজ। জেলার যে ‘হেভিওয়েট’ নেতাদের তিনি আমন্ত্রণ করেছিলেন, তাঁরা কেউ আসেননি। ফলে সমর্থকের সংখ্যার নিরিখে শক্তিপ্রদর্শন করতে পারলেও, সুব্রত সাহা বা মহম্মদ আলির মতো ‘বিক্ষুব্ধ’ তৃণমূল নেতাদের সঙ্গে জোট বাঁধার চেষ্টা সফল হল না হুমায়ুনের।
ইফতারের ভোজ বহুদিন ধরেই এ রাজ্যে রাজনীতির জনসম্পর্কের অঙ্গ হয়ে উঠেছে। রমজানের সন্ধ্যায় একত্র খাওয়া-দাওয়ার মধ্যে দিয়ে সামাজিক সৌজন্যের সঙ্গে রাজনৈতিক সমর্থন প্রদর্শনের রীতি দীর্ঘ দিনের। তবে মুর্শিদাবাদে তৃণমূলের প্রাক্তন কার্যকরী সভাপতি হুমায়ুন কবীরের এ দিনের ইফতারের সঙ্গে রাজনৈতিক কার্যক্রম জোড়াই ছিল। দলীয় সূত্রে খবর, ইফতার করার আগে এ দিন বিকালে বহরমপুরের সিরাজবাগে ঘণ্টা দুয়েক রুদ্ধদ্বার বৈঠক করার কথা ছিল। সেখানে থাকার কথা ছিল দলের প্রাক্তন দুই জেলা সভাপতি সুব্রত সাহা, মহম্মদ আলি ও মুর্শিদাবাদ জেলা প্রাথমিক বিদ্যালয় সংসদের প্রাক্তন সভাপতি সাগির হোসেনদের মতো নেতাদের। গত ১১ জুলাই জেলা পর্যবেক্ষক ইন্দ্রনীল সেনের তত্ত্বাবধানে যে দলীয় বৈঠক হয়, সেখানে জেলা তৃণমূলের কোনও কমিটিতে ঠাঁই মেলেনি এই নেতাদের।
এর পরেই হুমায়ুন ঘনিষ্ঠ মহলে জানিয়েছিলেন, এ ‘অপমান’ তিনি হজম করবেন না। সময় মতো ‘জবাব’ও দেবেন। তাঁর ডাকা ইফতার পার্টিতে ইন্দ্রনীল সেনকে না ডাকাই একটা ‘জবাব’, মনে করছেন অনেকেই। যদিও সুব্রত সাহা বা মহম্মদ আলি কখনওই হুমায়ুনের খুব ঘনিষ্ঠ ছিলেন না, তবু তাঁদের আমন্ত্রণ করে হুমায়ুন নতুন সমীকরণ তৈরি করে ইন্দ্রনীল-বিরোধিতার জমি শক্ত করতে চেয়েছিলেন, এমনই মনে করছে জেলার রাজনৈতিক মহল।
শেষ অবধি অবশ্য তা হয়নি। ফোনে সুব্রত সাহা বলেন, “ইফতার পার্টিতে যোগ দিতে আমি এখন কলকাতায়।” মহম্মদ আলি বলেন, “সিরাজবাগের ইফতারে আমার থাকার কথা ছিল না। তাই যাইনি।” আমন্ত্রণ পেয়েও আসেননি জঙ্গিপুর সুতির বিধায়ক ইমানি বিশ্বাস, ভগবানগোলার বিধায়ক চাঁদ মহম্মদ আর বহরমপুর লোকসভা কেন্দ্রের দলীয় সভাপতি সুবোধ দাস। হুমায়ুনের দাবি, ২১ জুলাইয়ের প্রস্তুতিতে ব্যস্ত থাকায় তাঁরা আসতে পারেননি। ফলে ওই রুদ্ধদ্বার বৈঠক বাতিল করে দেন হুমায়ুন। তবে প্রকাশ্যে বলেন, “এ ভাবে রুদ্ধদ্বার বৈঠক করা হলে দলের কাছে ভুল বার্তা যেতে পারে। তাই প্রস্তাবিত বৈঠক বাতিল করা হয়েছে।” এ দিন ইফতারের ভোজসভা থেকেই ২১ জুলাইয়ে সকলকে কলকাতায় যাওয়ার আহ্বানও জানান হুমায়ুন।
প্রথমে ইফতারের দিন ধার্য হয় ১৭ জুলাই। পরে দিন বদলে করা হয় ১৯ জুলাই। লক্ষাধিক টাকা খরচ করে হাজার লোকের জন্য বিশাল চত্বর জুড়ে ম্যারাপ বাঁধা হয়। হুমায়ুন বলেন, “লোকসভা ভিত্তিক দলের নবগঠিত কমিটির নেতাদের, এমনকী ইন্দ্রনীল সেনকেও ১৭ জুলাই-এর প্রস্তাবিত ইফতারে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলাম। কিন্তু পরিবর্তিত ১৯ জুলাইয়ের ইফতারে ইন্দ্রনীল ছাড়া জেলা নেতৃত্বের প্রায় সবাইকেই ডাকা হয়েছে।” তবে জেলার সদ্য-অপসারিত কয়েকজন নেতা না এলেও, ব্লক ও পঞ্চায়েত স্তরের হাজার খানেক দলীয় কর্মী উপস্থিত ছিলেন ইফতারে। প্রতি ব্লক থেকে এসেছিলেন বেশ কিছু কর্মী-সমর্থক। তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক মুকুল রায়ের ঘনিষ্ঠ রঞ্জন ভট্টাচার্যকেও দেখা যায় ইফতার সভায়। সিরাজবাগে জড়ো-হওয়া বিক্ষুব্ধ কর্মীরা এ দিন ইন্দ্রনীলের বিরুদ্ধে ক্ষোভ উগরে দেন। হুমায়ুনের সামনেই তাঁর অনুগামীরা আওয়াজ তোলেন, “ইন্দ্রনীল হঠাও, হুমায়ুন লাও, দল বাঁচাও।”
হুমায়ুনও ইন্দ্রনীলকে বিঁধতে ছাড়েননি। তিনি জানান, জেলার শতকরা ৭০ ভাগ মানুষ মুসলিম সম্প্রদায়ের। বিগত লোকসভা নির্বাচনে দলীয় তিন প্রার্থী মিলে প্রায় ৭ লক্ষ ভোট পেয়েছেন। তার মধ্যে ৫ লক্ষ ভোটই মুসলিম সম্প্রদায়ের। “ঈদের আর মাত্র ১০ দিন বাকি। ইন্দ্রনীল বা তাঁর নব গঠিত দলীয় কমিটি এ জেলার জন্য ইফতার পার্টির আয়োজন করেনি। তাই আমাকেই করতে হল,” বলেন হুমায়ুন। দলীয় সূত্রে খবর, ইন্দ্রনীল সেন বিকেলে মোবাইলে এসএমএস পাঠিয়ে হুমায়ুন কবীরের ইফতার ভোজের সাফল্য কামনা করেন।