সংস্কার হয় না খাল, বন্যার আশঙ্কায় বাসিন্দারা

সালটা ২০০০। যদিও ফি বছর বানভাসি হওয়াটাই কান্দির ভবিতব্য। তবু ২০০০ সালের বন্যার আতঙ্ক এখনও তাড়া করে স্থানীয় বাসিন্দাদের। সেই বন্যায় কান্দি শহরে চলেছে নৌকো, মাস খানেক জগৎ সংসার থেকে বিচ্ছিন্ন ছিল শহর। বেরোনার পথ না পেয়ে জলবন্দি হয়েছিলেন রাজ্যের তৎকালীন সেচমন্ত্রী দেবব্রত বন্দ্যোপাধ্যায় আর বিধানসভার বিরোধী দলনেতা, তথা ‘কান্দির রাজাবাবু’ অতীশ সিংহ।

Advertisement

অনল আবেদিন ও কৌশিক সাহা

কান্দি শেষ আপডেট: ২৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৫ ০১:১৯
Share:

যানজটে জেরবার কান্দির বাসিন্দারা।

সালটা ২০০০।

Advertisement

যদিও ফি বছর বানভাসি হওয়াটাই কান্দির ভবিতব্য। তবু ২০০০ সালের বন্যার আতঙ্ক এখনও তাড়া করে স্থানীয় বাসিন্দাদের। সেই বন্যায় কান্দি শহরে চলেছে নৌকো, মাস খানেক জগৎ সংসার থেকে বিচ্ছিন্ন ছিল শহর। বেরোনার পথ না পেয়ে জলবন্দি হয়েছিলেন রাজ্যের তৎকালীন সেচমন্ত্রী দেবব্রত বন্দ্যোপাধ্যায় আর বিধানসভার বিরোধী দলনেতা, তথা ‘কান্দির রাজাবাবু’ অতীশ সিংহ। খাবারের সঙ্কটে হাহাকার পড়ে গিয়েছিল। কপ্টার থেকে কান্দি শহরের বুকে ফেলা হয়েছিল শুকনো খাবার ও পানীয় জল, তাতেও মেটেনি প্রয়োজন।

সে আশঙ্কা নিতান্ত অমূলক নয়। গোটা শহরের নিকাশি ব্যবস্থার যথেষ্ট বেহাল দশা। অথচ ব্রিটিশ আমলে বিজ্ঞান সম্মত নিকাশি ব্যবস্থার প্রয়োজন মেটাতে খনন করা হয়েছিল ঐতিহাসিক স্বরূপখালি খাল। স্থানীয় বাসিন্দারা ওই খালকে বলত কান্দির টেমস। লন্ডন শহরের সঙ্গে তুলনার সেই গৌরব আজ আর নেই। পুরসভা ও সেচ দফতরের উদাসীনতা আর প্রচ্ছন্ন প্রশ্রয়ে ‘কান্দির টেমস’-এর দু’পাড় জবরদখল করে গড়ে উঠেছে ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান ও বসতবাড়ি। সংস্কারের অভাবে মজে যাওয়া স্বরূপখালি বর্তমানে কচুরিপানা ও আবর্জনায় ভরা ডোবায় পরিণত হয়েছে। সেই আশঙ্কা থেকে রেহাই দিতে স্মরণাতীত কালে ২০-২৫ ফুট চওড়া করে প্রায় ২০ কিলোমিটার দীর্ঘ স্বরূপখালি খাল কাটা হয়। কান্দি শহরের পশ্চিমপ্রান্ত দিয়ে বয়ে গিয়েছে ময়ূরাক্ষীর শাখানদী কানা ময়ূরাক্ষী। শহরের পূর্বপ্রান্তে রয়েছে একদা জল-জঙ্গলে ঘেরা কয়েক বর্গ কিলোমিটার বিস্তৃত ঐতিহাসিক হিজল অঞ্চল। কানা ময়ূরাক্ষী থেকে বের হয়ে কান্দি পুরসভা এলাকার ১, ৩, ৮, ৯, ১০, ১১, ১৫ এবং ১৬ নম্বর ওয়ার্ডের বুক চিরে স্বরূপখালি মিশেছে শহরের পূর্বপ্রান্তে আন্দুলবেড়িয়ার কাছে হিজল এলাকায়। শহরের অধিকাংশ নিকাশি নালা ওই খালের সঙ্গে যুক্ত ছিল। কানা ময়ূরাক্ষীর উৎসমুখ থেকে ব্যাঙ্কমোড় পর্যন্ত এলাকায় স্বরূপখালিতে তিনটে লকগেট ছিল। লকগেটগুলি আজ অচল। প্রধান নিকাশিনালা স্বরূপখালিও মজে গিয়েছে। জবরদখল হয়ে তার উপর বসতবাড়ি ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের ঘর উঠেছে। কচুরিপানা ও আবর্জনায় ভরে উঠেছে জলাশয়। অথচ ঠিকঠাক রক্ষণাবেক্ষণ ও নিয়মিত সংস্কার ও সৌন্দর্যায়ন হলে ওই জলসম্পদ নিকাশিনালা ছাড়ায় শহরের অবসর বিনোদনের উল্লেখযোগ্য স্থান হিসাবে মর্যাদা পেত। গুরুত্বপূর্ণ ও জরুরি সেই কাজটি না হওয়ায় সেচ দফতর ও পুরসভা নিজেদের ঘাড় থেকে দায় সরিয়ে ফেলে পরস্পরের বিরুদ্ধে দোষারোপ করতে ব্যস্ত।

Advertisement

সেচ দফতরের কান্দি মহকুমা আধিকারিক শিবপ্রসাদ রায় বলেন, “সেচ দফতর ওই খাল সংস্কারে উদ্যোগী হয়েছিল। সেই কাজে পুরসভার সহযোগিতা চাওয়া হয়। কিন্তু পুরসভার পক্ষ থেকে প্রয়োজনীয় সহযোগিতা না পাওয়ায় কিছুটা কাজ করার পর খাল সংস্কারের কাজ বন্ধ রাখতে হয়েছে।” পুরসভার প্রশ্রয়ে খাল ও খালপাড় দখল করে বাড়িঘর উঠেছে বলে অভিযোগ। সেচ দফতরের তোলা অসহযোগিতার অভিযোগ অস্বীকার করে বরাবর কংগ্রেসের দখলে থাকা কান্দির পুরপ্রধান গৌতম রায় বলেন, “পুরসভার অনুমতি নিয়ে খালপাড়ে কেউ বাড়িঘর তৈরি করেনি। পুনর্বাসনের বিনিময়ে জবরদখল উচ্ছেদ করব এমন জমিও নেই পুরসভার হাতে। আমাদের আবেদনে সেচ দফতর স্বরূপখালি সংস্কার শুরু করেছিল। নামমাত্র কচুরিপানা তুলে ফেলে অজ্ঞাত কারণে সেচ দফতর হাত গুটিয়ে নিয়ে এখন আমাদের উপর মিথ্যা দোষারোপ করছে।” স্বরূপখালি খালের মতোই বেহাল দশা এই শহরের ডোবা ও পুকুর মিলিয়ে ৫১৪টি জলাশয়ে। কান্দি উকিলসভার সম্পাদক সফিউর রহমান বলেন, “অন্য জলাশয়গুলি সংস্কার না হওয়ায় নিকাশি সমস্যা তীব্র।”

আবর্জনায় বন্ধ হয়েছে নালা।

নিকাশির মতোই অসহনীয় যানজটের ভোগান্তি এ শহরের রোজনামচা। রাজ্য সড়ক থেকে শহরের ভিতরে ঢোকা ও বেরে নার রাস্তা মাত্র তিনটি। কান্দি বাসস্ট্যান্ড থেকে সব্জি বাজার হয়ে মহকুমা হাসপাতাল দিয়ে আদালতমুখী রাজপথটিই মুখ্য। বাকি গৌণপথ দু’টির একটি, দোহালিয়া মোড় থেকে শুরু করে বিডিও অফিসের পাশ দিয়ে আদালতমুখী রাস্তাটি। তৃতীয়পথ হল, দোহালিয়া কালীবাড়ি মোড় হয়ে রসড়া দিয়ে আদালতমুখী রাস্তা।

যে রাস্তাটি বাসস্ট্যান্ড থেকে বেরিয়ে শহরে ঢুকেছে, তার অধিকাংশই জবরদখল করেছে বিভিন্ন ধরনের ব্যবসায়ী ও সব্জিবাজারের বিক্রেতারা। রাত তিনটে থেকে সেখানে বেচাকেনা চলে। কান্দির পাইকারি ও খুচরো সব্জি বিক্রেতারা সমবেত হন ওই বাজারে। ফলে দিনভর অসহনীয় যানজট। তার উপরে ওই পথেই চলে করে ২০০ টুকটুক, রিকশা এবং ভ্যান মিলিয়ে আরও ৪৫০০টি গাড়ি। কংগ্রেসের স্থানীয় নেতা শাশ্বত মুখোপাধ্যায় বলেন, “প্রশাসন ও পুরসভা যৌথ ভাবে উদ্যোগী হলে কান্দি শহরের প্রধানতম রাজপথ জবরদখল মুক্ত করে চলাচল যোগ্য করা সম্ভব।” কিন্তু করে কে?

পুরপ্রধান গৌতমবাবুর অভিযোগ, “বহু প্রাচীন পুরসভা। তবুও রাজ্য সরকার কান্দিকে চতুর্থ শ্রেণির পুরসভার পর্যায়ে আটকে রেখেছে। উন্নয়নমূলক খাতে কম বরাদ্দ জোটে।” অচলায়তনের মতো কয়েক যুগের যানজট কমাতে নতুন দু’টি রাস্তা নির্মাণের পরিকল্পনার কথা জানালেন পুরপ্রধান। কান্দি বাসস্ট্যান্ড লাগোয়া ব্রিজের পশ্চিমপ্রান্তের কানা ময়ূরাক্ষীর পাড় বরাবর একটি পাকা সড়ক নির্মাণ করা হবে। ওই রাস্তা কানা ময়ূরাক্ষীর উপর হিউম পাইপের উপর দিয়ে গিয়ে নদীর পূর্বপাড়ের থানার কাছে গিয়ে মিলিত হবে। অন্যদিকে রূপপুর থেকে বাঘবাটীর মোড় পর্যন্ত প্রায় ৩ কিলোমিটার দীর্ঘ সড়কটি খালপাড়ের উপর ১৬ ফুট চওড়া হবে। তবে এই রাস্তা নির্মাণের নেপথ্যে যানজটের থেকে অন্য প্রয়োজন জরুরি বলে মনে করেন কান্দির অনেকেই। খালপাড়ের প্রস্তাবিত ওই রাস্তা লাগোয়া ৫০-৬০ বিঘা জমি কিনে পুরসভার কয়েকজন ঘনিষ্ঠ রাজনৈতিক ব্যক্তি ‘কান্দি নিউ টাউন’ গড়ার প্রকল্প নিয়েছেন। নিন্দুকদের দাবি, “শহরের যানজট মুক্ত করার থেকেও প্রস্তাবিত ‘নিউ টাউন’-এর জন্য আশু প্রয়োজন রূপপুর-বাঘবাটী সড়কপথ।”

ছবি : গৌতম প্রামাণিক।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement