সাইলেন্সর বদলানোর পরে। ছবি: বিশ্বজিৎ রাউত।
মালিকের পরিচয় জানা যাবে মোটর বাইকের আওয়াজে। তবেই না শখের দাম দেড় লাখ!
কিন্তু বহরমপুরের শো রুম থেকে গাঁটের টাকা খরচ করে বাইক কেনার পর মনখারাপ হয়ে গিয়েছিল ডোমকলের গোলাপ শেখের। বাইকের গতিতে চুলে হাওয়া লাগলেও মন যেন কিছুতেই খুলছিল না। সেই শব্দ কোথায়? পিছনের আসনে বসা বন্ধুকে গোলাপ আক্ষেপ করে বলেছিলেন, “এত টাকা দিয়ে এনফিল্ড কিনলাম। কিন্তু সেই শব্দই যদি না হল তা হলে আর লোকে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাবে কেন?” পরে অবশ্য মুশকিল আসান করে দেন বহরমপুরের এক গ্যারাজ মিস্ত্রি। কিন্তু তার জন্য যে আরও হাজার চারেক টাকা খরচ করতে হবে। হাতে যেন চাঁদ পান গোলাপ, “দেড় লাখ টাকা দিয়ে সখের গাড়ি যখন কিনতে পেরেছি। সাধের শব্দের জন্য না হয় আর চার হাজারও গুণব। তবে আওয়াজ কিন্তু মনের মতো হওয়া চাই।” নতুন সাইলেন্সর বদলে ফেলতেই ফিরে এল সেই কাঙ্খিত আওয়াজ। চায়ের দোকানের সামনে সিঙ্গল স্ট্যান্ডে দাঁড় করানো বাইকের সিটে হেলান দিয়ে হাসছেন গোলাপ, “গাড়ি তো নয়, যেন বাঘের বাচ্চা।” গোলাপ একা নন, ডোমকল মহকুমায় এনফিল্ড বাইক নিয়ে চলছে এমনই ‘পাগলামি’। কার বাইকে আওয়াজ কত বেশি তাই নিয়ে তুফান উঠছে পাড়ার দোকানের চায়ের কাপেও। প্রায় ২ লক্ষ টাকা খরচ করে ৫০০ সিসি ইঞ্জিনের এনফিল্ড কিনেছেন ডোমকলের আসরাফ আলি। তিনিও বহরমপুরে গিয়ে নতুন গাড়ির সাইলেন্সর বদলে ফেলেছেন। আসরাফ বলছেন, “এক লক্ষ ছিয়ানব্বই হাজার টাকা দিয়ে বাইক কিনে প্রথমে খুব হতাশ হয়ে পড়েছিলাম। শেষতক গ্যারাজে গিয়ে সাইলেন্সর বদলে নিয়েছি।”
ডোমকলের এনফিল্ডের আর এক মালিক পল্টু বিশ্বাস বলছেন, “সাইলেন্সর বদলাতে অতিরিক্ত কিছু টাকা খরচ করতে হয়েছে ঠিকই। কিন্তু আওয়াজ শুনলেই মন ভাল হয়ে যাচ্ছে।”
সীমান্তবর্তী ডোমকল মহকুমা এলাকায় বছর কয়েক আগেও দু’একজন প্রভাবশালী ব্যক্তি ছাড়া রয়্যাল এনফিল্ড বাইকের কথা ভাবতেই পারতেন না সাধারণ মানুষ। গুরুগম্ভীর আওয়াজ তুলে পাড়া কাঁপিয়ে দেওয়া ওই বাইকে ঘুরতেন কিছু বিএসএফ ও পুলিশকর্মীরা। স্থানীয় বাসিন্দা আব্দুল হামিদ বলছেন, “আগেকার বুলেট চালানোর অনেক ঝামেলা ছিল। সেভাবে মাইলেজ পাওয়া যেত না। স্টার্ট দেওয়া ছিল কঠিন কাজ। তাছাড়া গিয়ার ও ব্রেক সিস্টেম ছিল অন্য বাইকের থেকে একেবারে উল্টো। কিন্তু এখন বুলেটের ভোল বদলে গিয়েছে। গিয়ার ও ব্রেক অন্য বাইকের মতোই। তাছাড়া সেল্ফ স্টার্ট রয়েছে। মাইলেজও আগের থেকে অনেক ভাল। ফলে আবার বুলেট কেনার ঝোঁক বেড়েছে মানুষের।” হামিদের সংযোজন, “মানুষ কিনছেন নতুন বুলেট। কিন্তু আওয়াজ চাইছেন পুরনো। সেই কারণেই সাইলেন্সর বদলের ধুম পড়েছে।”
বহরমপুরের এক গ্যারাজের মিস্ত্রি বাপি মণ্ডল বলেন, “সাইলেন্সর বদলে যে আওয়াজ হুবহু সেই পুরনো বুলেটের মতো হচ্ছে এমনটা নয়। তবে আওয়াজ অনেক জোরালো হচ্ছে। আর তাতেই লোকজন বেজায় খুশি। আমার গ্যারাজে এই সাইলেন্সর বদলের ভিড় ভালই হচ্ছে।”
রয়্যাল এনফিল্ডের বহরমপুরের এক শো-রুমের মালিক ললিত তলোয়ার বলেন, “নতুন এনফিল্ডের চাহিদা এত বেড়ে গিয়েছে যে আমরা সেই চাহিদা মতো সরবরাহ করতে পারছি না।” আর সাইলেন্সর-বদল নিয়ে তাঁর বক্তব্য, “শো-রুমে কিংবা বাইরের কোনও গ্যারাজে সাইলেন্সর বদলানো যায়। শব্দের তারতম্য ঘটাতে সেটা এখন অনেকেই করছেন।” তবে সাইলেন্সর বদলের ফলে মালিকের পরিচিতি যেমন বেড়েছে, তেমনি তার ফলও হাড়ে হাড়ে নয়, একেবারে কানের ভিতর দিয়ে মরমে মরমে টের পাচ্ছেন এলাকার বাসিন্দারা। তাঁদের বক্তব্য, “কী শব্দ রে বাবা! ঘুমন্ত মানুষও জেগে উঠবে। এদিকে আবার গাড়ির পিছনে লিখে রেখেছে- ‘দেখলে হবে খরচা আছে।’ কিংবা ‘হিংসা নয়...চেষ্টা করো।’ এরপর আর কী বলার থাকতে পারে, বলুন?”