মামলার তারিখ মিলতে ঘুরে যাচ্ছে বছর

কোনও মামলার বয়স ৩৪ বছর। কোনও মামলা নিষ্পত্তির আগেই মারা গিয়েছেন খোদ অভিযোগকারী। কোনওটিতে আবার মারা গিয়েছেন মূল সাক্ষী কিংবা অভিযুক্ত। কৃষ্ণনগর ও বহরমপুর, দুটি জেলা আদালতেই বছরের পর বছর ঘুরছেন বিচারপ্রার্থী মানুষ। তারিখের পর তারিখ নিয়ে হয়রান হচ্ছেন তাঁরা। এমনকী একাধিক ফাস্ট ট্র্যাক কোর্টেও নেই বিচারক।

Advertisement

শুভাশিস সৈয়দ ও সুস্মিত হালদার

বহরমপুর ও কৃষ্ণনগর শেষ আপডেট: ০১ জানুয়ারি ২০১৫ ০১:১৪
Share:

কোনও মামলার বয়স ৩৪ বছর। কোনও মামলা নিষ্পত্তির আগেই মারা গিয়েছেন খোদ অভিযোগকারী। কোনওটিতে আবার মারা গিয়েছেন মূল সাক্ষী কিংবা অভিযুক্ত। কৃষ্ণনগর ও বহরমপুর, দুটি জেলা আদালতেই বছরের পর বছর ঘুরছেন বিচারপ্রার্থী মানুষ। তারিখের পর তারিখ নিয়ে হয়রান হচ্ছেন তাঁরা। এমনকী একাধিক ফাস্ট ট্র্যাক কোর্টেও নেই বিচারক।

Advertisement

আদালত সূত্রে জানা গিয়েছে, কৃষ্ণনগর জেলা জজ আদালত ও নিম্ন আদালতে এজলাসের সংখ্যা বাড়ানো হয়েছে। কিন্তু তারপরেও কৃষ্ণনগর জেলা জজ আদালত, নিম্ন আদালত-সহ নানা বিষয়ের বিশেষ আদালত মিলিয়ে ২০১৪ সালের ডিসেম্বর মাস পর্যন্ত প্রায় ৪২ হাজার মামলা ঝুলে রয়েছে। পড়শি জেলা মুর্শিদাবাদের সদর শহর বহরমপুরে সেই সংখ্যাটা দ্বিগুণেরও বেশি। জমা মামলা এক লক্ষ ছাড়িয়েছে, বলছেন আইনজীবীরা।

ওই দুই জেলার আইনজীবীরা জানাচ্ছেন, সংকট এমনই তীব্র যে অনেক ক্ষেত্রে মামলার পরবর্তী তারিখ মিলছে ১৪ থেকে ১৬ মাস পরেও। বিচার-প্রক্রিয়ার এই দীর্ঘসূত্রিতার কারণে অনেক সময় যথাযথ বিচার পাওয়াটাও অনিশ্চিত হয়ে পড়ছে। কৃষ্ণনগর সিজেএম আদালতের সরকার পক্ষের আইনজীবী অরুণ পাইক জানান, মামলা দীর্ঘ দিন ধরে চলার ফলে বহু সাক্ষী ঘটনার কথা ভুলে যান। অভিযোগকারী, গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষী, এমনকী অভিযুক্তরাও মারা যান। “অনেক সময়ে প্রকৃত অপরাধীরা ছাড়া পেয়ে যাচ্ছে। তাছাড়া বিচারপ্রার্থীদের হয়রানি তো আছেই,” বলেন অরুণবাবু।

Advertisement

বহরমপুর সিজেএম আদালতের এক আইনজীবী জানান, ফৌজদারী কার্যবিধি আইনের ১২৫ নম্বর ধারায় বলা হয়েছে, খোরপোষের মামলা ছ’মাসের মধ্যে নিষ্পত্তি করতে হবে। অথচ বাস্তবে সেই মামলার নিষ্পত্তি হতে লাগছে দুই থেকে চার বছর।

কৃষ্ণনগরের ফেডারেশন অফ বার অ্যাসোসিয়েশনের যুগ্ম সম্পাদক দেবাশিস রায় বলেন, “যে মামলা ১৯৮০ সাল থেকে এখনও চলছে সেই মামলার আর কী থাকতে পারে? মামলা যত দিন গড়াবে ততই সাক্ষীদের বিরূপ হওয়ার সম্ভাবনা বাড়ে। তাই বিভিন্ন মামলায় বিরূপ সাক্ষীর সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে।”

কৃষ্ণনগর জেলা আদালতের পাবলিক প্রসিকিউটর সত্যেন্দুশেখর সেন বলেন, “বহু মানুষ এই মুহূর্তে বিচারাধীন বন্দি হয়ে জেলে আছেন। ঠিক সময়ে মামলার নিষ্পত্তি হয়ে গেলে তাঁদের অনেকেই নির্দোষ প্রমাণিত হয়ে বন্দিদশা থেকে মুক্তি পেয়ে যেতেন।”

কৃষ্ণনগর জেলা সংশোধনাগার সূত্রে খবর, এখন ৭২৮জন বন্দি রয়েছেন। তাঁদের মধ্যে ৬০৭জনই বিচারাধীন বন্দি। বহরমপুর জেলা সংশোধনাগার সূত্রে খবর, সেখানে প্রায় ২০০০ বন্দি রয়েছেন। তার মধ্যে বিচারাধীন প্রায় ১২০০। গড়ে দু-তিন বছর বিচারাধীন থাকতেই হচ্ছে অভিযুক্তদের।

বহরমপুর বার অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি তথা মুর্শিদাবাদ জেলার সরকারি পিপি আবু বক্কর সিদ্দিকি বলেন, “বহরমপুর জেলা জজ ও মুর্শিদাবাদ সিজেএম আদালতে মোট ১৯টি এজলাস রয়েছে। সব এজলাস মিলিয়ে এখনও পর্যন্ত প্রায় লক্ষাধিক মামলার নিষ্পত্তি হয়নি।” এর জন্য সরকারি উদাসীনতাকেই দায়ী করছেন তিনি।

আবু বক্কর সিদ্দিকির বক্তব্য, “হাইকোর্ট রুটিন-মাফিক কাজ করে দায় সারে। আর সরকার বিচার ব্যবস্থার প্রতি উদাসীন। ফলে মামলা নিষ্পত্তিতে বিলম্ব হচ্ছে।”

নদিয়া জেলা আদালত সূত্রে জানা গিয়েছে, এই মুহূর্তে জেলা জজ আদালত-সহ, শিশুদের উপর যৌন নির্যাতন বিচারের ‘পসকো’ আদালত, নেশাদ্রব্য সংক্রান্ত ‘এনডিপিএস’ আদালতে জমে থাকা মামলার সংখ্যা প্রায় এক হাজার। বিদ্যুৎ পরিষেবা-সংক্রান্ত বিশেষ আদালতে পড়ে থাকা মামলার সংখ্যা প্রায় সাড়ে তিন হাজার। এ ছাড়াও নিম্ন আদালতে প্রায় ৩৭ হাজারেরও বেশি মামলার নিষ্পত্তি হয়নি। অথচ বছরখানেক আগে জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটের আরও দুটি এজলাস বাড়ানো হয়েছে। কিন্তু মামলার সংখ্যা কমা তো দূরের কথা, ক্রমশ বেড়েই চলেছে।

একই অবস্থা বহরমপুরেও। বহরমপুর জেলা জজ আদালতে রয়েছে ১৫টি এজলাস, কিন্তু বিচারক ১৩জন। এ ছাড়া গত আট মাস ধরে তিনটি ফাস্ট ট্র্যাক আদালতের দুটিতে (প্রথম ও তৃতীয়) কোনও বিচারকই নেই। সুবিচার না পাওয়ার ঝুঁকি আরও বাড়িয়েছে আদালতে পরিকাঠামোর অভাব।

মুর্শিদাবাদের এক আইনজীবী পীযুষ ঘোষ বলেন, “সিজেএম আদালতের বিভিন্ন এজলাসে যেখানে দাঁড়িয়ে আমরা সওয়াল করি, সেই মেঝেতেই পড়ে থাকে গুরুত্বপূর্ণ মামলার নথিপত্র। এমনকী বিচারকের টেবিলেও মামলার ফাইল উপচে পড়ছে। ওইসব গুরুত্বপূর্ণ নথি রাখার জায়গা পর্যন্ত আদালতে নেই।”

বহরমপুর এনডিপিএস আদালতের সরকারি আইনজীবী কাঞ্চনলাল মুখোপাধ্যায় বিচারে বিলম্বের জন্য পুলিশ ও চিকিৎসকদের একাংশকেও দায়ী করছেন। তাঁর কথায়, “পুলিশ ও চিকিৎসকেরা অনেক ক্ষেত্রে সঠিক সময়ে সাক্ষ্য দিতে আদালতে হাজির হন না। সেই কারণেই শুধু তারিখের পর তারিখ আসে। মামলা পড়েই থাকে।”

জেলার আর এক আইনজীবী শুভাঞ্জন সেনগুপ্তের কথায়, “আদালতের সমন পাঠানো হয় পুলিশের মাধ্যমে। অনেক সময়ে পুলিশের গড়িমসির জন্য ঠিক সময়ে সমন পৌঁছয় না। মামলায় দেরি হয়ে যায়।” তাঁর প্রস্তাব, এই কাজটি পুলিশকে না দিয়ে বিচারব্যবস্থার নিজস্ব কোনও সংস্থার মাধ্যমে করানো হলে ভাল হত।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement