মৃদঙ্গের তালে তাল মিলিয়ে মেক্সিকো থেকে মেদিনীপুর

দোল লেগেছে নবদ্বীপে। শহরের পথে পথে আশ্চর্য সব মিছিল। কোনও মিছিলের যাত্রা উত্তর থেকে দক্ষিণে তো কেউ চলেছেন পশ্চিম থেকে পুবে। এ মিছিলে কেউ স্লোগান দেয় না। ভক্তরা এক সঙ্গে গান গায়। মৃদঙ্গের তালে পায়ে পা মিলিয়ে পথ হাঁটে মেক্সিকোর সঙ্গে মেদিনীপুর। কুয়ালালমপুরের সঙ্গে কীর্তনে সুর মেলায় কাজাখস্তানের নাগরিক।

Advertisement

দেবাশিস বন্দ্যোপাধ্যায়

নবদ্বীপ শেষ আপডেট: ২৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৫ ০১:০৯
Share:

রং-দোল উপলক্ষে পরিক্রমায় বেরিয়েছেন বিদেশিনীরা। —নিজস্ব চিত্র।

দোল লেগেছে নবদ্বীপে। শহরের পথে পথে আশ্চর্য সব মিছিল। কোনও মিছিলের যাত্রা উত্তর থেকে দক্ষিণে তো কেউ চলেছেন পশ্চিম থেকে পুবে। এ মিছিলে কেউ স্লোগান দেয় না। ভক্তরা এক সঙ্গে গান গায়। মৃদঙ্গের তালে পায়ে পা মিলিয়ে পথ হাঁটে মেক্সিকোর সঙ্গে মেদিনীপুর। কুয়ালালমপুরের সঙ্গে কীর্তনে সুর মেলায় কাজাখস্তানের নাগরিক। সারা পৃথিবীর শতাধিক দেশ থেকে ছুটে আসা লাখো মানুষের এমন অসংখ্য ছোটবড় মিছিল ঘুরে বেড়ায় চৈতন্যস্মৃতি বিজড়িত বৃহত্তর নবদ্বীপে। নানা ভাষার মানুষের মুখে বিচিত্র উচ্চারনে কৃষ্ণনাম শোনা যায় এই মিছিলে। সংকীর্তনের প্রচলিত চেনা সুরে লাগে ইউরোপ, লাতিন আমেরিকার লোকগান বা ক্যালিপসোর ছোঁয়াচ। এ মিছিলের পোশাকি নাম ‘নবদ্বীপ মণ্ডল পরিক্রমা।’

Advertisement

প্রাচীন মায়াপুর, বিদ্যানগর, জাহান্নগর, রাজাপুর, বেলপুকুর, মামগাছি বা হরিহরক্ষেত্রের মতো নবদ্বীপ এবং লাগোয়া বর্ধমানের বিশেষ কিছু জায়গায় দোলের ১৫ দিন আগে থেকে শুরু হয়ে যায় পরিক্রমা। সব মিলিয়ে ৭২ কিলোমিটার পথ। সন্ন্যাস গ্রহণের আগে নবদ্বীপে বিশ্বম্ভর মিশ্রের যাতায়াত ছিল যে সব জায়গায়, সেই সব স্থানে সংকীর্তন-পরিক্রমার মধ্যে দিয়েই নবদ্বীপে দোল উৎসবের উদ্যাপন। নবদ্বীপ-মায়াপুরের দোল যত না শ্রীকৃষ্ণের তার থেকে অনেক বেশি শ্রীচৈতন্যের। তাঁর আবির্ভাব তিথি পালন এখনকার দোলের মূল আকর্ষণ। দস্তুর হল তার আগে সাত দিন, পাঁচ দিন বা তিন দিন, নিতান্ত অক্ষম হলে একটা দিন - পায়ে পায়ে ছুঁয়ে যাওয়া চৈতন্যধামের ভগ্ন দেউল, নদীর পাড়, প্রান্তর, পাড়া গা।ঁ এখানে গঙ্গার দু’পাড়ের ছোট বড় সব মঠমন্দিরই তাদের মতো করে পৃথক ভাবে আয়োজন করে পরিক্রমার।

ইস্কনের তরফে রসিক গৌরাঙ্গ দাস বলেন, “এবার বিশ্বের ১০০টি দেশ থেকে আসা মোট ১২ হাজার দেশি বিদেশি ভক্তকে নিয়ে আমাদের পরিক্রমা শুরু হয়েছে। কাজের সুবিধার জন্য এদের ছ’টি দলে ভাগ করা হয়েছে। টানা সাত দিন ছয় রাত ধরে চলবে পরিক্রমা। ২৮ ফেব্রুয়ারি পরিক্রমা শেষ হবে।”

Advertisement

এই ছ’টি দলকে মূলত ভাষার ভিত্তিতে ভাগ করা হয়েছে। শুধু রাশিয়ানদের জন্য একটি পৃথক দল। বাকি বিদেশিদের জন্য একটি দল। পরিক্রমায় সেই দলটি ‘ইন্টারন্যাশনাল’ নামে চিহ্নিত। হিন্দিভাষীদের জন্য একটি পৃথক দল। আবার বাংলাভাষীদের আলাদা দল, সেটি ‘নামহট্ট’ নামে চিহ্নিত। আদতে সুবিধার জন্যই এই দল ভাগ, স্পষ্টই জানালেন রসিক গৌরাঙ্গ দাস।

পরিক্রমার জন্য মোট ছ’টি জায়গায় রাত্রিবাসের শিবিরও করা হয়েছে। সপ্তাহব্যাপী সব ক’টি দল ঘুরিয়ে ফিরিয়ে যাবেন প্রতিটি জায়গায় এবং শিবিরে রাত্রিবাস করবেন। তার আয়োজনও কম নয়। সেপ্টেম্বর থেকেই প্রস্তুতি শুরু হয়ে যায়। মোট দেড় হাজার লোক এই পরিক্রমার নেপথ্যে। এতগুলি দলের জলখাবার, দুপুরের খাবার এবং রাত্রির খাবারের যাবতীয় রান্না করা হয় মায়াপুরে। তারপর ট্রাকে করে সেই সব খাবার বিভিন্ন জায়গায় পৌঁছে দেওয়া হয়। দল বুঝে বদলে যায় মেনু। মায়াপুরে ইস্কন মন্দিরের জনসংযোগ আধিকারিক রমেশ দাস বলেন, “সকালের জলখাবারে সাধারণত হাল্কা খিচুড়ি, চপ, চাউমিন, ম্যকারনি, ফ্রুটজুস, বেলের সরবত থাকছে। ৯টা থেকে ১০ টার মধ্যে জলখাবার দেওয়া হয়। মধ্যাহ্ন ভোজন ২টো থেকে ৩টের মধ্যে। মেনুতে ডাল-ভাত, সবজি, নানারকম নিরামিষ পদ, পায়েস, মিষ্টি সঙ্গে একটা ফল থাকে। রাতে অবশ্য মুড়ি আর দুধ। সাড়ে আটটার মধ্যে। তবে দল বুঝে বদলে যায় কিছু খাবার। যেমন হিন্দিভাষীদের দলে ভাতের বদলে চাপাটি। ইন্টারন্যাশনালে ‘বেকড ব্রেড’ বা রাশিয়ানদের ব্রাউন ব্রেড ইত্যাদি।”

পরিক্রমার প্রস্তুতিতে ব্যস্ত সব মঠমন্দিরও। নবদ্বীপে সব থেকে বড় পরিক্রমা বের হয় দেবানন্দ গৌড়ীয় মঠ এবং কেশবজি গৌড়ীয় মঠ থেকে। পুলিশ জানিয়েছে বিগত বছরে দৈর্ঘ্যের বহরে সব থেকে বড় ছিল দেবানন্দ গৌড়ীয় মঠের পরিক্রমা। নবদ্বীপ থানার আইসি তপন কুমার মিশ্র বলেন, “গত বছরের মোট দু’লক্ষ মানুষ পরিক্রমায় অংশ নিয়েছিলেন। শুধু দোলের দিন নবদ্বীপের খেয়াঘাট দিয়ে ৯৬ হাজার ৪০০ লোক পারাপার করেছিলেন। আমাদের ধারণা এবার সেই সংখ্যা আরও বাড়বে।”

এ বছর মাধ্যমিক পরীক্ষার সঙ্গেই চলছে পরিক্রমা। তাই বাড়তি সতর্কতা নিয়েছে প্রশাসন। মাইকের ব্যবহার নিষিদ্ধ, রয়েছে অতিরিক্ত পুলিশও।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement