বিরোধী দলের পোলিং এজেন্টের বাড়িতে ভাঙচুর, ভোটারদের প্রভাবিত করা, ভয় দেখানো, বুথ জ্যাম, ছাপ্পা ভোট থেকে প্রিসাইডিং অফিসারের অপসারণ কোনও কিছুই বাদ গেল না চাকদহ বিধানসভা উপ-নির্বাচনে। নদিয়া জেলার অন্যত্র মোটামুটি শান্তিপূর্ণ ভাবে দিন কাটলেও চাকদহে ভোট হল সন্ত্রাসের আবহেই।
দু’জায়গায় তৃণমূলের আক্রমণের নিশানায় ছিলেন সিপিএমের পোলিং এজেন্ট। চাকদহে কলেজ বুথের সিপিএমের পোলিং এজেন্ট ইলা সিংহের অনুপস্থিতিতে তৃণমূল আশ্রিত দুষ্কৃতীরা তাঁর বাড়িতে ভাঙচুর চালায় বলে অভিযোগ। ইলাদেবী তখন ভোটকেন্দ্রে ছিলেন। তাঁর বাড়ি কলেজ থেকে খানিকটা দূরে চাকদহ পুরসভার ৪ নম্বর ওয়ার্ডের রবীন্দ্রনগরে। বিকাল চারটে নাগাদ একদল দুষ্কৃতী এসে তাঁর বাড়িতে ভাঙচুর চালায়। ইলাদেবীর মেয়ে রিয়া সিংহ বলেন, ‘হঠাৎ শব্দ শুনে বাইরে বেরিয়ে আসি। দেখি ১০-১২ জন যুবক ভাঙচুর চালাচ্ছে। মুখে মাস্ক ছিল। তবে চিনেছি। ওরা সকলেই তৃণমূলের কর্মী।” এই নিয়ে গত চব্বিশ ঘণ্টায় চারজন সিপিএম কর্মীর বাড়িতে ভাঙচুর চালানোর অভিযোগ উঠেছে তৃণমূল কর্মীদের বিরুদ্ধে। এ দিনই বিকেলে বাড়ি ফেরার পথে সিপিএমের এক পোলিং এজেন্টকে মারধর করে তৃণমূলের লোকেরা। নারায়ণ দাশগুপ্ত নামে বসন্তকুমারী বালিকা বিদ্যাপীঠের ৬৫ নম্বর বুথের ওই পোলিং এজেন্ট চাকদহ স্টেট জেনারেল হাসপাতালে চিকিৎসাধীন।
বস্তুত, রবিবার রাত থেকেই কার্যত ভোট শুরু করে দিয়েছিল তৃণমূল কংগ্রেস। গত চাকদহ পুরসভা নির্বাচনে তৃণমূল বেপরোয়া সন্ত্রাস চালিয়েছিল বলে অভিযোগ উঠেছিল। তার এক বছর পরে চাকদহ বিধানসভার উপ-নির্বাচনের দিন ‘নীরব সন্ত্রাস’ চালানোর অভিযোগ উঠল তৃণমূলের বিরুদ্ধে। সকাল থেকেই ভোটকেন্দ্র থেকে খানিকটা দূরে বিভিন্ন মোড়ে জটলা দেখা যায়। যাঁরা বিরোধী ভোটার, বিশেষত সিপিএম সমর্থক এমনকী যাঁদের রাজনৈতিক পরিচয় নিয়ে সন্দেহ রয়েছে, তাঁদেরও ভোটকেন্দ্রে যেতে বাধা দেওয়া হচ্ছিল জটলা থেকে। লাইনে দাঁড়িয়ে থাকা ভোটারদের ডেকে নিয়ে গিয়ে ভয় দেখিয়ে বের করে দেওয়া হয়েছে বলে অভিযোগ।
পুরসভার ৩০ নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দা সুদেব সরকার বলেন, “আমি বামপন্থী ভোটার। এটা এলাকার সকলেই জানে। সে জন্য লাইনে দাঁড়িয়ে থাকার সময় কথা আছে বলে আমাকে ডেকে নিয়ে যায়। খানিকটা দূরে নিয়ে গিয়ে ভয় দেখায়। বাধ্য হয়ে ভোট না দিয়ে চলে এসেছি।” ৪ নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দা কৌশিক মুখোপাধ্যায় বলেন, “সোমবার যাতে ভোট দিতে না যাই সে জন্য রবিবার থেকে দফায়-দফায় তৃণমূল বাহিনী আমাকে ভয় দেখিয়েছে। প্রথমে দুপুর দেড়টা নাগাদ রাস্তায়, শেষে রাত দু’টো নাগাদ বাড়িতে এসে ভয় দেখায়।”
ভোটকেন্দ্রে পৌঁছেও শান্তি নেই। রানাঘাটের চাকদহের বিপিনবিহারী বিদ্যাপীঠের ৫৫ নম্বর বুথে তৃণমূলের লোক ঢুকে পড়ছিল ভোটারদের সঙ্গে। পর্যবেক্ষক তা হাতেনাতে ধরতে পেরে ওই কেন্দ্রের প্রিসাইডিং অফিসারকে সরিয়ে দেন। অপসারিত প্রিসাইডিং অফিসার অনীক কাষ্ঠ বলেন, “এক ভোটারের সঙ্গে আর এক জন ঢুকে পড়েন ভোটগ্রহণ কেন্দ্রে। নিয়মমতো, এর জন্য ফর্ম ভরতে হয়। আমি ফর্ম দেওয়ার আগেই ওই যুবক ভিতরে ঢুকে যান। সেই সময় পর্যবেক্ষক চলে আসেন। এর বেশি কিছু বলতে পারব না।” বুথে জোর করে ঢোকার অভিযোগে ওই যুবককেও গ্রেফতার করা হয়েছে। ধৃত গোপাল প্রামাণিক তৃণমূলকর্মী বলে পরিচিত এলাকায়। চাকদহে আরও বেশ কিছু এলাকায় বুথ জ্যাম, ভোটদানে বাধা-সহ নানা অভিযোগ উঠেছে শাসকদলের বিরুদ্ধে।
তার উপরে এ দিন সকাল থেকে বেশ কিছু ইভিএম অচল হয়ে যায়। ফলে সংশ্লিষ্ট বুথগুলিতে ভোটগ্রহণের কাজ শুরু হতে কিছুটা দেরি হয়। দায়িত্ব যথাযথ ভাবে পালন না করার অভিযোগে চাকদহ দুর্গানগর বিপিনবিহারী বিদ্যাপীঠের প্রিসাইডিং অফিসার অনীক কাষ্ঠকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। সেই জায়গায় শিবাশিস দাসকে দায়িত্ব দেওয়া হয়।
জেলা সিপিএমের সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য অমল ভৌমিক বলেন, “রবিবার রাত থেকে সন্ত্রাস শুরু করেছে তৃণমূল। সন্ত্রাসের কারণে শহরের ৩০টি এবং গ্রামে ৯টি বুথে পোলিং এজেন্ট দেওয়া সম্ভব হয়নি। আমাদের ভোট দিতেও বাধা দেওয়া হয়েছে। ছাপ্পাও পড়েছে দেদার।”
জেলা কংগ্রেস সভাপতি শঙ্কর সিংহের অভিযোগ, “শহরের বিভিন্ন জায়গায় ভোটারদের তৃণমূলকর্মীরা বাধা দিচ্ছিল। কয়েকটি জায়গায় আমরাও পোলিং এজেন্ট দিতে পারিনি।” এ দিকে কোনও বুথেই বিজেপি-র পোলিং এজেন্ট পাওয়া যায়নি। এ ব্যাপারে জেলা বিজেপি-র সভাপতি কল্যাণ নন্দী বলেন, “আমরা এজেন্ট দেওয়ার ব্যাপারে খুব একটা জোর দিইনি। বাড়ি-বাড়ি প্রচারে বিষয়ে গুরুত্ব দিয়েছিলাম। যারা ভোট দেওয়ার, তারা আমাদের ভোট দেবেন।”
সব অভিযোগ উড়িয়ে দিয়ে জেলা তৃণমূলের সভাপতি গৌরীশঙ্কর দত্ত বলেন, “কেউ এজেন্ট দিতে না পারার দায় আমাদের নয়। ওখানে শান্তিপূর্ণ ভোট হয়েছে। কোথাও কোন গণ্ডগোল হয়নি। আমাদের দলের কেউ কোনও ভাঙচুরের ঘটনায় যুক্ত নয়।”