ভোট দিয়েই মাকে খুনের বদলা নীলিমার

আঠারোর অধিকার। প্রথম ভোটদান। এ সব কিছুই আরও একটু অন্য রকম নীলিমা বাগের কাছে। আড়াই মাস আগের ঘটনার প্রতিবাদ যেন মূর্ত হয়ে উঠল শুক্রবার ভোটকেন্দ্রে। স্ত্রীর মৃতদেহ জড়িয়ে ধরে সে দিন কান্নায় ভেঙে পড়েছিলেন অপর্ণা বাগের স্বামী। সেদিন কিছুই করতে পারেন নি। শুধু নীরবে শপথ নিয়েছিলেন সুযোগ পেলে বদলা নেবেন। এ দিন তাই সকাল সকালই বড় মেয়েকে সঙ্গে নিয়ে দিলেন দেবানন্দ বাগ।

Advertisement

সুস্মিত হালদার

কৃষ্ণগঞ্জ শেষ আপডেট: ১৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৫ ০২:০৭
Share:

ভোটের লাইনে নীলিমা বাগ ও দেবানন্দ বাগ। শুক্রবার সুদীপ ভট্টাচার্যের তোলা ছবি।

আঠারোর অধিকার। প্রথম ভোটদান। এ সব কিছুই আরও একটু অন্য রকম নীলিমা বাগের কাছে। আড়াই মাস আগের ঘটনার প্রতিবাদ যেন মূর্ত হয়ে উঠল শুক্রবার ভোটকেন্দ্রে।

Advertisement

স্ত্রীর মৃতদেহ জড়িয়ে ধরে সে দিন কান্নায় ভেঙে পড়েছিলেন অপর্ণা বাগের স্বামী। সেদিন কিছুই করতে পারেন নি। শুধু নীরবে শপথ নিয়েছিলেন সুযোগ পেলে বদলা নেবেন। এ দিন তাই সকাল সকালই বড় মেয়েকে সঙ্গে নিয়ে দিলেন দেবানন্দ বাগ। স্ত্রী-কে খুনের প্রতিবাদ জানাতে। ২৩ নভেম্বর সকালে নদিয়ার কৃষ্ণগঞ্জের ঘুঘড়াগাছি গ্রামে জমি রক্ষা করতে গিয়ে দুষ্কৃতীদের গুলিকে খুন হয়েছিলেন অপর্ণা বাগ। ট্রাক্টর আর লোক লস্কর নিয়ে জমি দখল করতে এসেছিল দুষ্কৃতীরা। খবর শুনেই সব ভুলে ছুটেছিলেন অপর্ণাদেবী তাঁর শেষ সম্বল বাঁচাতে। স্বপ্ন বোনা এক চিলতে জমিতে ট্রাক্টরের সামনে দু’হাত তুলে রুখে দাঁড়িয়েছিলেন। সে সময় ছুটে আসা গুলিতে সর্ষে খেতের ভিতর লুটিয়ে পড়েন তিনি।

গোটা ঘটনাটাই নিজেদের চোখে দেখেছিল দুই মেয়ে নীলিমা আর দেবিকা। নবম শ্রেণির ছাত্রী দেবিকা। এখনও ভুলতে পারে না সে দৃশ্য। আর বাবার হাত ধরে বুথে ঢোকার নীলিমা আগে জানিয়ে দেন, “চোখের সামনে দেখেছি, মাকে নৃশংস ভাবে মারল। সে দিন কাউকে কিছু বলতে পারিনি। আজ নির্বাচন কমিশন প্রতিবাদ করার সেই সুযোগটা দিয়ে দিয়েছে। সেটা হারাতে চাই না।” দেবানন্দবাবু বলেন, “প্রশাসন তো দোষীদের কোনও শাস্তি দিতে পারল না। আমরাই বদলা নিলাম ভোট দিয়ে।”

Advertisement

ঘুঘড়াগাছি কাণ্ডে জড়িয়ে গিয়েছিল শাসক দলের নাম। মূল অভিযুক্ত লঙ্কা ওরফে লঙ্কেশ্বর ঘোষ তৃণমূলের ব্লক সভাপতি লক্ষ্মণ ঘোষ চৌধুরীর ঘনিষ্ঠ বলে দাবি করেছিল বিরোধীরা। পরে লঙ্কা ঘোষ নিজেও স্বীকার করেছিলেন সে কথা জানিয়েছিলেন।

ঘটনার পর থেকে সিপিএময়ের সূর্যকান্ত মিশ্র থেকে বিমান বসু, বিজেপি-র শমীক ভট্টাচার্য থেকে জয়প্রকাশ মজুমদার, জেলা কংগ্রেসের তাবড় নেতা ছুটে গিয়ে সহানুভূতি জানিয়েছিলেন অপর্ণাদেবী-সহ ঘটনায় আক্রান্ত পরিবারগুলিকে। কিন্তু সেই পর্যন্তই। সিপিএম ছাড়া কেউই পরে আর খবর রাখেনি ওই পরিবারগুলির। তবে ঘটনার পরে গ্রামে ঢুকতেই পারেনি তৃণমূল। গ্রামের বাইরে সভা করেই ফিরে আসে তারা।

আড়াই মাসের মধ্যে বিধানসভা উপনির্বাচনে তাই শুধু অপর্ণা বাগের পরিবারই নয়, সে দিনের নির্মম ঘটনার প্রতিবাদ করতে একক্কাট্টা হয়েছে গোটা ঘুঘড়াগাছি। ভোটের দিনেও অপর্ণাদেবীর কথা মনে পড়ছিল প্রতিবেশী হিরা সর্দারের। এর আগে যতবার ভোট দিতে গিয়েছেন সঙ্গে গিয়েছেন পাশের বাড়ির অপর্ণাদেবী। এদিন বেলা সাড়ে ১০ টা নাগাদ দেবানন্দবাবুদের সঙ্গে তিনিও ভোট দিয়ে আসেন। হীরাদেবী বলেন, “এত বছর ধরে দু’জনে মিলে ভোট দিতে এসেছি। আজ সেই মানুষটা নেই। দলাদলিতে প্রাণ গেল ভাল মানুষটার।”

অপর্ণাদেবীকে কেউ কোনও দিন কোনও দলের মিটিং মিছিলে হাঁটতে দেখেননি। একটু ভিতুই ছিলেন তিনি। সেই মানুষটাই কিনা ও ভাবে সকলের আগে ছুটে গেল বন্দুকের সামনে। কোথা থেকে এল এত মনেক জোর ভেবেই অবাক হয়ে যান হীরাদেবী। তবু বলেন, “প্রতিবাদ তো হবেই। রাস্তায় বন্দুক হাতে প্রতিবাদ করতে পারব না। তাই ভোট দিয়ে প্রতিবাদ করব।”

বাড়ি থেকে সামান্য দূরে ঘুঘড়াগাছি প্রাথমিক স্কুলে ভোট গ্রহণকেন্দ্র। জলপাই রঙের উর্দি পড়া কেন্দ্রীয় বাহিনীর কড়া দৃষ্টি। বুথ থেকে একটু দূরে ভোটের স্লিপ হাতে দাঁড়িয়ে রাজকুমার মণ্ডল। সে দিন গুলিতে গুরুতর জখম হয়েছিলেন তাঁর ছেলে রাজীব মণ্ডল। উর্দিধারীদের দিকে তাকিয়ে রাজকুমারবাবু বলেন, “দেখুন এখন কত পুলিশ, কত নিরাপত্তা। সেদিন কিন্তু কারও দেখা পাইনি। কেউ এগিয়ে আসেনি।” ঘটনার পরে ক্ষুব্ধ গ্রামবাসীরা অভিযোগ তুলেছিলেন, বারবার থানায় ফোন করেও লাভ হয়নি। পুলিশ এসেছে সব শেষ হয়ে যাওয়ার পর। রাজকুমারবাবু আবারও বলেন, “সে দিন পুলিশ এলে হয়ত মানুষটা মরত না, আমার ছেলেটাও পঙ্গু হয়ে যেত না।”

সেদিন অল্পের জন্য বেঁচে গিয়েছিলেন শ্যামলি তরফদার। চোয়াল গুড়িয়ে বেরিয়ে গিয়েছিল গুলি। দীর্ঘ দিন তিনি মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করে বাড়ি ফিরেছেন। এ দিন ভোট দিতে এসেছিলেন তাঁর স্বামী উত্তম তরফদারও। ভাঙা পায়ের প্রতিবন্ধকতা অগ্রাহ্য করে। তাড়াতাড়ি ভোটটা দিতে পেরে তবেই শান্তি। তিনি বলেন “যে ভাবে সেদিন আমাদের উপরে হামলা হয়েছিল তার তো একটা বদলা চাই। ওদের ছাড়ব না। আমার মত করে শাস্তি দেব।’’

ঘুঘড়াগাছি গ্রামের পাশেই ২২ বিঘা জমি বহু বছর আগে ভাগ করে দেওয়া হয়েছিল ভূমিহীন ৫৬টি পরিবারের ভিতরে। প্রত্যেকের ভাগে পড়েছিল আট কাঠা করে। সেই ২২ বিঘা মমির উপরেই নজর পড়েছিল এলাকায় তৃণমূল কর্মী বলে পরিচিত বেশ কয়েক জনের। সেই মত তারা অস্ত্রসস্ত্র নিয়ে লঙ্কা ঘোষের নেতৃত্বে হানা দিয়েছিল সে দিন সকালে। গ্রামবাসীদের তরফে প্রতিবাদ নেমে আসতেই শুরু হয় নির্বিচারে গুলি আর বোমা বর্ষণ। ঘটনার পর একক্কাট্টা হয়ে প্রতিবাদ করেন গ্রামের মানুষ। নিরাপত্তার তোয়াক্কা না করেই লঙ্কা ঘোষ-সহ দুষ্কৃতীদের বিরুদ্ধে পুলিশে অভিযোগ দায়ের করেছিলেন গ্রামের যুবক শুভঙ্কর বিশ্বাস। এদিনও তাঁর চোখ দুটো জ্বলে ওঠে। ক্ষোভের সঙ্গে বলেন “অভিযুক্তদের মধ্যে মাত্র দু’জন গ্রেফতার হয়েছে। কি করল তাহলে পুলিশ?”

বোঝা যায় শাসক দলের প্রতি ক্ষোভের আগুন এখনও দাউদাউ। তাই গ্রামে ঢুকতে পারে না তৃণমূল। যদিও তৃণমূলের জেলা সভাপতি গৌরীশঙ্কর দত্ত দাবি করেন, ওই ৬৫টি পরিবারের মধ্যে ৪২টি পরিবারই তাদের সঙ্গে আছে। তাঁরা নাকি তৃণমূলের হয়ে প্রচারেও বেরিয়েছিলেন।

যদিও বাস্তবটা আদৌ এমন নয় বলেই দাবি করেছেন ঘুঘড়াগাছির মানুষ। তাঁদের অভিযোগ নানা হুমকি এসেছে। তাতে কাজ না হওয়ায় ওই জমির পাট্টার ব্যবস্থা করে দেওয়ার মত প্রলোভনও এসেছে।

কিন্তু মচকায়নি ঘুঘড়াগাছির ঐক্য। বুথের দিকে যেতে যেতে গ্রামের বাসিন্দা সীমান্ত বিশ্বাস, তারাপদ রায়রা বলেন, “আলবাত এক আছি! জানেন না গ্রামের ভিতরেই অপর্ণা বাগের শহিদবেদি তৈরি হয়েছে। সেটা যতদিন থাকবে আমরাও এক থাকব। দেখে নেবেন।’’

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement