ভোট দিয়েই জবাব দেবে নিহত জওয়ানের গ্রাম

ভোটের কাজে গিয়ে মাওবাদী হানায় প্রাণ হারিয়েছেন গ্রামের ছেলে। তাই ভোট দিয়েই মাওবাদীদের প্রতীকী জবাব দিতে চান ছত্তীসগঢ়ে নিহত জওয়ান চন্দ্রকান্ত ঘোষের গ্রাম রঘুুনাথপুর-পলিশার লোকজন। মাওবাদী অধ্যুষিত বস্তার লোকসভা কেন্দ্রের বুরকাপাল এলাকায় ভোটকর্মীদের পৌঁছিয়ে ফেরার পথে বুধবার সকালে কোবরা বাহিনীর একটি দল জঙ্গিদের মুখে পড়ে।

Advertisement

কৌশিক সাহা

ভরতপুর শেষ আপডেট: ১১ এপ্রিল ২০১৪ ০৪:২৭
Share:

জওয়ানের শোকাহত পরিবার। বৃহস্পতিবার। ছবি: গৌতম প্রামাণিক।

ভোটের কাজে গিয়ে মাওবাদী হানায় প্রাণ হারিয়েছেন গ্রামের ছেলে। তাই ভোট দিয়েই মাওবাদীদের প্রতীকী জবাব দিতে চান ছত্তীসগঢ়ে নিহত জওয়ান চন্দ্রকান্ত ঘোষের গ্রাম রঘুুনাথপুর-পলিশার লোকজন।

Advertisement

মাওবাদী অধ্যুষিত বস্তার লোকসভা কেন্দ্রের বুরকাপাল এলাকায় ভোটকর্মীদের পৌঁছিয়ে ফেরার পথে বুধবার সকালে কোবরা বাহিনীর একটি দল জঙ্গিদের মুখে পড়ে। মাওবাদীদের গুলিতে ঝাঁঝরা হয়ে যায় তিন জওয়ানের দেহ। নিহতদের মধ্যে রয়েছেন মুর্শিদাবাদ জেলার ভরতপুর থানার রঘুনাথপুর-পলিশার চন্দ্রকান্ত ঘোষ (২৫)। বুধবারই দুুপুরবেলা খবর এসে পৌঁছয় গ্রামের বাড়িতে। তখনও দুপুরের খাওয়া হয়নি। তারপর থেকে জলটুকুও গলায় নামেনি কারও।

চন্দ্রকান্তেরা চার ভাই, দুই বিবাহিত দিদি। বাবা মহাদেব ঘোষ চাষবাস করেন। ছোট্ট মাটির বাড়ি পাকা তিন কামরার হয়েছিল মেজ ছেলে চন্দ্রকান্ত সেনাবাহিনীতে চাকরি পাওয়ার পরেই। সংসারে স্বাচ্ছন্দ্য ফিরলেও ছেলেকে নিয়ে চিন্তার শেষ ছিল না বাড়ির লোকের। চলতি বছর ফেব্রুয়ারি মাসে ছেলের বিয়ে দেওয়ার পর বৌমাকে নিয়ে উদ্বেগটা আরও বেড়েছিল যেন।

Advertisement

বিয়ের বাইশ দিনের মাথায় মহারাষ্ট্রে চলে গিয়েছিলেন চন্দ্রকান্ত। ভোটের আগে মাওবাদী অধ্যুষিত ছত্তীসগঢ়ে বদলি হওয়ার নির্দেশ এলে তিনি নিজেও ‘অজানা বিপদে’র ভয় করছিলেন। বাড়ির লোকেদের চিন্তা করতে বারণ করলেও গ্রামের ঘনিষ্ঠ বন্ধু দেবব্রত ঘোষকে ফোন করে বেশ কয়েক বার সেই আশঙ্কার কথা বলেছিলেন তিনি।

ঘটনার এক দিন আগে মঙ্গলবার সন্তানসম্ভবা স্ত্রী-কে ফোন করে অবশ্য ‘সব ঠিক আছে’ বলেই আশ্বস্ত করেছিলেন চন্দ্রকান্ত। পরদিন দুপুরে আচমকা অশুভ সংবাদটা শোনার পর থেকে তাই কথা বলার ক্ষমতা হারিয়েছেন স্ত্রী শ্রাবণী। বৃহস্পতিবার সকালে তিনি এতটাই অসুস্থ হয়ে পড়েন যে গ্রামের চিকিৎসককে ডাকতে হয়। দু’বোতল স্যালাইনের পর সামান্য সুস্থ হয়ে শ্রাবণী বলেন, “মাওবাদীরা ভোটের বিরোধিতা করে এই কাণ্ড ঘটাল। ভোট দিয়েই তাই ওদের বিরোধিতা করব। ক্ষমতায় যে-ই আসুক, মাওবাদীদের যেন উৎখাত করতে পারে। এই ভাবে আর কারও সংসার যেন উজাড় না হয়।” কিছুক্ষণের মধ্যেই ফের জ্ঞান হারান শ্রাবণী। চন্দ্রকান্তের মা জ্যোৎস্নাদেবীকে তুলনায় শক্ত দেখাচ্ছিল। তিনি বলেন, “দেশরক্ষা করতে দিয়ে মৃত্যু হয়েছে আমার ছেলের। এত দুঃখের মধ্যে ওটাই সান্ত্বনা। তবে, যারা মায়ের কোল থেকে ছেলেকে কেড়ে নিল, তারা যে কী আদর্শে এমন করে বেড়াচ্ছে, বুঝতে পারলাম না।”

আরও এক ধাপ সুর চড়িয়ে চন্দ্রকান্তের মাসতুতো দাদা গোপীনাথ পাল, বন্ধু মিঠুন মণ্ডলরা বলেন, “প্রায়ই দেখি মাওবাদী হানায় সেনারা মারা যাচ্ছে। এত বড় দেশে, এত সৈন্য থাকার পরেও এটা হয় কী করে? মাওবাদী নির্মূল করার সদিচ্ছাটাই আসলে নেই সরকারের। ভোট দিয়ে শক্তিশালী সরকার বানাতে হবে, যারা সবার আগে দেশের ভিতরের সুরক্ষা নিশ্চিত করবে।”

বৃহস্পতিবার সকাল থেকেই ‘পরোপকারী’ চন্দ্রকান্তের বাড়ির সামনে ভিড় জমাতে শুরু করেন গাঁয়ের লোকজন। চারদিকে কান্নার রোল। শোকের ছায়ায় গ্রামে উনুন জ্বলেনি অধিকাংশ বাড়িতে। বিকেলবেলা কলকাতা থেকে চন্দ্রকান্তের দেহ এসে পৌঁছয় বাড়িতে। ১৬৯ ব্যাটেলিয়নের কম্যান্ডান্ট জয়ন্ত মজুমদারের নেতৃত্বে দুর্গাপুর থেকে একটি দল এসে ‘গান স্যালুট’ করে। তার আগে রাজ্য পুলিশের দলও ‘গার্ড অফ অনার’ দেয়। এরপর বহরমপুর শ্মশানের উদ্দেশে রওনা হয় মরদেহ।

কান্দির মহকুমাশাসক প্রদীপ বিশ্বাস বলেন, “রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় অন্ত্যেষ্টির ব্যবস্থা করা হয়েছে বীর জওয়ান চন্দ্রকান্ত ঘোষের। ওই মাওবাদী হানায় জখম হয়েছেন জেলারই খড়গ্রাম থানার বাতুড় গ্রামের আরও এক যুবক। তিনি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন।”

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement