পলাশির ইতিহাস ঢেকেছে আগাছা-আবর্জনায়

ঐতিহাসিক পলাশির প্রান্তর। সেখানে আজও দাঁড়িয়ে আছেন সিরাজ, রয়েছেন তাঁর সেনাপতি মীরমদন আর মোহনলাল। কিন্তু বড়ই অযত্নে। ইতিহাসকে ধরে রাখার জন্য ‘ঐতিহাসিক স্থান’ হিসেবে ঘোষণা করেই দায় ঝেড়ে ফেলেছে রাজ্য সরকার। যথাযথ সংরক্ষণের কোনও উদ্যোগই নেই। তাই ‘ঐতিহাসিক ভূমি’ কার্যত পতিত ভূমিতে পরিণত হয়েছে। প্রতি বছর হাজার হাজার পর্যটক আসেন ইতিহাসের টানে।

Advertisement

নিজস্ব সংবাদদাতা

পলাশি শেষ আপডেট: ০৫ জুলাই ২০১৪ ০০:৩৬
Share:

দর্শক নেই। রক্ষীও নেই। অযত্নে পড়ে স্মৃতিসৌধ। নিজস্ব চিত্র।

ঐতিহাসিক পলাশির প্রান্তর। সেখানে আজও দাঁড়িয়ে আছেন সিরাজ, রয়েছেন তাঁর সেনাপতি মীরমদন আর মোহনলাল। কিন্তু বড়ই অযত্নে।

Advertisement

ইতিহাসকে ধরে রাখার জন্য ‘ঐতিহাসিক স্থান’ হিসেবে ঘোষণা করেই দায় ঝেড়ে ফেলেছে রাজ্য সরকার। যথাযথ সংরক্ষণের কোনও উদ্যোগই নেই। তাই ‘ঐতিহাসিক ভূমি’ কার্যত পতিত ভূমিতে পরিণত হয়েছে। প্রতি বছর হাজার হাজার পর্যটক আসেন ইতিহাসের টানে। কিন্তু ফিরে যেতে হয় একরাশ হতাশা নিয়ে।

১৭৫৭ সালের ২৩ জুন, পলাশির আম বাগানে বাংলার তরুণ নবাব সিরাজ-উদ-দৌলা, ইংরেজ ইস্ট কোম্পানির গভর্নর ক্লাইভের মুখোমুখি হয়েছিলেন। বাকি ইতিহাস সকলের জানা। দেবদারু গাছের সারি পেরিয়ে পলাশির রণক্ষেত্রে গিয়ে পৌঁছলেই হতশ্রী চেহারাটা চোখে পড়ে। সরকারি উদ্যোগে রাস্তার ধারেই তৈরি করা হয়েছে একটি স্মৃতিসৌধ। দুধ সাদা ওই সৌধের মাঝে কালো কালিতে লেখা- ‘পলাশির যুদ্ধক্ষেত্র’। সারা বছরই পর্যটকদের জন্য ওই যুদ্ধক্ষেত্রের প্রবেশ পথ খোলা থাকে বটে। কিন্তু হয় না রক্ষণাবেক্ষণ। ওই সৌধটির আশেপাশেই কতকাল আগে যে ঝাঁট পড়েছিল তা মনে করতে পারেন না স্থানীয় বাসিন্দারা। পাঁচিলে ঘেরা যুদ্ধক্ষেত্রের চৌহদ্দিতে আবর্জনার ছড়াছড়ি। চায়ের ভাঁড়, বিড়ি-সিগারেটের পরিত্যক্ত প্যাকেট, পানের পিক, সবই জমা হয়ে রয়েছে স্মৃতিসৌধে পাঁচিলের মধ্যে। সবুজ আগাছা তো আছেই।

Advertisement

এই সামগ্রিক অব্যবস্থার মধ্যেই চোখে পড়ে সৌধের গায়ে লেখা রয়েছে ‘‘ঐতিহাসিক পুরকীর্তিটিকে পশ্চিমবঙ্গ ঐতিহাসিক পুরাকীর্তি ও পুরাবস্তু সংরক্ষণ এবং প্রত্নক্ষেত্র খনন আইন ১৯৫৭-এর ৩ ধারা অনুসারে ক্ষতি, অঙ্গনাশ, বিকৃতসাধন করিলে ৫ হাজার টাকা জরিমানা বা ৩ মাস জেল হতে পারে।’’ এ সবই কথার কথা জানালেন স্থানীয় এক যুবক। সৌধের পাশেই কংক্রিটের একটি স্তম্ভের উপর গরমের দুপুরে আদুর গায়ে বসেছিলেন তিনি। বিজ্ঞপ্তির কথা উঠতেই ওই যুবকের কটাক্ষ, ‘‘ও কেবল কথার কথা। বাস্তবের সঙ্গে মেলে না। সৌধের সংরক্ষণের ব্যাপারে কারও কোনও উদ্যোগ নেই। দেখেছেন এখানে কোনও নজরদারি?’’

বাস্তবিকই ঘণ্টা খানেক কাটিয়েও সৌধের আশপাশে সরকারি বা বেসরকারি নিরাপত্তা সংস্থার কোনও কর্মীর দেখা মিলল না। সৌধের পাশেই রয়েছে সিমেন্টের তৈরি বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজ-উদ-দৌলার মূর্তি। নায়কের স্মৃতিস্তম্ভকেও সংরক্ষণের ব্যাপারে কারও হোলদোল নেই। মূর্তির গা থেকে খসে পড়েছে সিমেন্টের আস্তরণ। বহরমপুরের বাসিন্দা রবিউল হোসেন আত্মীয় স্বজনদের নিয়ে ঘুরতে এসেছিলেন পলাশির আমবাগানে। কথায়-কথায় তিনি উগরে দিলেন ক্ষোভ, ‘‘পাশের গ্রামে এক আত্মীয়র বাড়িতে এসেছিলাম। ভাবলাম যুদ্ধস্থলটা একবার ঘুরে যাই। কিন্তু এখানে তো দেখছি কিছুই নেই।”

সৌধের অদূরে মাঠের মধ্যে রয়েছে নবাব পক্ষের সেনাপতি মীরমদন, মোহনলালের মূর্তি। কিন্তু পর্যটকরা শত চেষ্টাতেও ওই মূর্তির আশপাশে ঘেঁষতে পারবেন না। কারণ, অন্তত পাঁচশো মিটার বন-বাদাড় ও ধানের জমি পেরিয়ে মিলবে শহিদদের মূতির্। মোরাম রাস্তার পাশে স্থানীয় ভুরুলিয়া গ্রামের যুবক জোয়াদ আলি পথ দেখিয়ে বললেন, ‘‘সেনাপতিদের মূর্তি দেখতে হলে আলপথে অন্তত মিনিট পনেরো হাঁটতে হবে। এই জন্য ওদিকে কোনও পর্যটকই পা বাড়ান না।’’ সত্যিই যে দু’একজন পর্যটকের দেখা মিলল, ইচ্ছা থাকলেও অগম্য পথ পেরিয়ে কেউই গেলেন না মীরমদন-মোহনলালের মূর্তি দেখতে।

তবে নদিয়া জেলা প্রশাসন সার্কিট ট্যুরিজমের অধীনে জেলার বেশ কিছু দর্শনীয় স্থানকে সাজানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। তার মধ্যে পলাশির যুদ্ধক্ষেত্র অন্যতম। কিন্তু সে কাজ চলছে ঢিমেতালে। এখনও অবধি প্রকল্পের বিস্তারিত রিপোর্ট তৈরি হয়নি। জেলা পরিষদের সচিব অভিরূপ বসু বলেন, ‘‘পূর্ত দফতরের বেশ কিছু জায়গা ওখানে রয়েছে। যুদ্ধের উপর ভিত্তি করে তৈরি করা হবে মিউজিয়াম। দ্রুত ওই কাজ শুরু হবে।’’ কিন্তু সেই কাজ কবে হবে? শত-শত বছর ধরে পুরাকীর্তির অযত্ন দেখে আসা স্থানীয় লোকজন প্রশাসনের কেষ্টবিষ্টুদের মুখের কথার উপর আর তাই বিশেষ ভরসা রাখতে পারছে না।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement