বছর পেরোতে আর মাসখানেক বাকি। বহরমপুরের সাড়াজাগানো একই পরিবারের তিন মহিলা খুনের মামলায় সাক্ষ্যগ্রহণ চলছে শম্বুক গতিতেই। অভিযোগ, পুলিশের গাফিলতিতে মামলার কাজ এগোচ্ছে না ঠিক মতো। কখনও বাজেয়াপ্ত সামগ্রী আদালতে পেশের ক্ষেত্রে দায়সারা মনোভাবের অভিযোগ উঠছে পুলিশের বিরুদ্ধে, কখনও উপস্থিতিতে অনীহা। এই প্রেক্ষিতে কাল, ৯ ডিসেম্বর ফের ওই মামলার সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু হতে চলেছে।
২০১৪ সালের ৬ জানুয়ারি বহরমপুরের আশাবরী আবাসনের ‘ডি’ ব্লকের নীচের তলার একটি ফ্ল্যাটের তালা ভেঙে মধ্য চল্লিশের বিজয়া বসু, তাঁর পিসি বৃদ্ধা প্রভা দাস এবং তরুণী কন্যা আত্রেয়ী বসুর দেহ উদ্ধার করে পুলিশ। তদন্তে নেমে পুলিশ দাবি করে, ‘কালসর্পদোষ’ খণ্ডনের নামে নিত্যানন্দ দাস নামে এক জ্যোতিষী ওই বাড়িতে ঢুকে তিন জনকে শ্বাসরোধ করে খুন করেছেন। কয়েকদিনের মধ্যে শিলিগুড়ি থেকে নিত্যানন্দকে গ্রেফতারও করে ফেলে পুলিশ। পরে আদালতের নির্দেশে নিত্যানন্দের জেল হেফাজত হয়।
জেলা জজ আদালতের বিচারক প্রসেনজিৎ বিশ্বাসের এজলাসে গত ১০ সেপ্টেম্বর থেকে ওই মামলার সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু হয়েছে। অভিযুক্তপক্ষের আইনজীবী বরেন রায় জানান, গত ১০ সেপ্টেম্বর বিজয়াদেবীর দিদি ইরা মিত্রের সাক্ষ্যগ্রহণ হয়। পরের দিন ১১ সেপ্টেম্বর থেকে শুরু হয় ইরাদেবীর স্বামী কৃষ্ণাশিস মিত্রের সাক্ষ্যগ্রহণ। ওই সাক্ষ্যগ্রহণ চলাকালীন বিজয়াদেবীর ফ্ল্যাট থেকে বাজেয়াপ্ত করা যাবতীয় জিনিসপত্র হাজির করানোর জন্য আদালতে আবেদন জানান বরেনবাবু। তাঁর অভিযোগ, “আবেদন মেনে বিচারক ওই মামলার তদন্তকারী পুলিশ অফিসারকে বাজেয়াপ্ত জিনিসপত্র আদালতে হাজির করানোর নির্দেশ দিলেও এখনও তা করতে পারেনি পুলিশ। ফলে ওই মামলায় একের পর এক দিন পড়ছে। এতে সাক্ষ্যগ্রহণপর্ব পিছিয়ে যাচ্ছে।”
বরেনবাবু জানান, গত ১২ সেপ্টেম্বর পুলিশ বেশ কিছু সামগ্রী আদালতে হাজির করেছিল। কিন্তু তার সঙ্গে বাজেয়াপ্তের তালিকার কোনও মিল ছিল না। তখন বিচারক পরবর্তী দিন ধার্য করেন ৫ নভেম্বর (পুজোর ছুটি ছিল মাঝে)। ওই দিনই বাজেয়াপ্ত করা যাবতীয় সামগ্রী আদালতে হাজির করানোর নির্দেশ দেন তিনি। বরেনবাবুর অভিযোগ, “বাজেয়াপ্ত করা সমস্ত জিনিসপত্র গত ৫ নভেম্বর আদালতে হাজির করে পুলিশ। কিন্তু তার কোনও প্যাকিং ছিল না। এমনকী কোনও লেবেলও সাঁটা ছিল না। পুলিশের এই গাফিলতি দেখে বিচারক ক্ষুব্ধ হয়ে ওই মামলার তদন্তকারী অফিসারকে বাজেয়াপ্ত করা জিনিস-সহ আদালতে হাজির হওয়ার নির্দেশ দেন।” ফের মামলার দিন পড়ে গত ২৪ নভেম্বর। ওই দিন আবার আদালতে পুলিশ অনুপস্থিত ছিল বলে বরেনবাবু জানান। ফের মামলার দিন ঘোষণা হয় ৯ ডিসেম্বর।
এই মামলার অন্য এক অভিযুক্ত (বর্তমানে জামিনে মুক্ত) উমর শেখের আইনজীবী কাঞ্চনলাল মুখোপাধ্যায়ও বিরক্ত পুলিশের ভূমিকায়। ফ্ল্যাট থেকে গয়না চুরি করে নিয়ে গিয়ে নিত্যানন্দ এই উমর শেখের কাছেই তা বিক্রি করেছিলেন বলে অভিযোগ। কাঞ্চনবাবু বলেন, “খুনের ঘটনাস্থল থেকে পুলিশ যে সমস্ত জিনিসপত্র বাজেয়াপ্ত করেছিল, সেগুলি আদালতে হাজির করতে পারছে না কিছুতেই। ফলে মামলা নিষ্পত্তির ক্ষেত্রে বিলম্ব হচ্ছে।”
সরকারি আইনজীবী বা বহরমপুরের পুলিশ অবশ্য গড়িমসির অভিযোগ মানতে নারাজ। তদন্তকারী অফিসার সুব্রত ভট্টাচার্য পুজোর পর সুতি থানায় বদলি হয়ে গিয়েছেন। তাঁর কথায়, “আদালতে সময় শেষ হয়ে যাওয়ায় ১২ সেপ্টেম্বর বাজেয়াপ্ত জিনিসগুলি পেশ করা যায়নি। ৫ নভেম্বর এক অভিযুক্ত উমর শেখ হাজির ছিলেন না। পরের তারিখ ২৪ নভেম্বরের বিষয়টি আমি জানতাম না।” সরকারি আইনজীবী আবু বাক্কার সিদ্দিকিও বলেন, “পুলিশ বাজেয়াপ্ত করা জিনিসপত্র আদালতে হাজির করেছিল। সেই দিন ওই মামলার অন্য অভিযুক্ত উমর শেখ অনুপস্থিত ছিলেন। আদালতে মাত্র এক দিন হাজির হতে পারেনি পুলিশ।” আর মুর্শিদাবাদের পুলিশ সুপার সি সুধাকর “বিষয়টি জানা নেই” বলে উত্তর এড়িয়ে গিয়েছেন।
এদিকে, নিত্যানন্দ এখন শারীরিক ভাবে অসুস্থ। তাঁর চিকিৎসার বন্দোবস্ত করার জন্য নিত্যানন্দের আইনজীবী বরেনবাবু গত ২৪ নভেম্বর বিচারকের কাছে আবেদন জানিয়েছিলেন। বিচারক সেই আবেদন মেনে নিত্যানন্দের জন্য মেডিক্যাল বোর্ড গঠনের নির্দেশ দিয়েছেন জেল সুপারকে। এই অবস্থায় মামলার গতি আরও ধীর হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা করছে বাদীপক্ষ। বিজয়াদেবীর স্বামী দেবাশিসবাবু বলেন, “আমি দ্রুত নিত্যানন্দের মৃত্যুদণ্ড চাই। মামলার নিষ্পত্তি হতে আর কত দেরি হবে জানি না।” একই কথা বলছেন বিজয়াদেবীর দিদি ইরাদেবীও।
ঘটনা হল, বাদী বা বিবাদী পক্ষ নয়, পুলিশি সক্রিয়তার উপরেই নির্ভর করছে মামলার গতি।