এক থেকে দুই। তেরো থেকে ২৬। পুর নির্বাচনকে সামনে রেখে নবদ্বীপে ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে সিপিএম।
সম্প্রতি ১৩-সদস্যের নবদ্বীপ লোকাল কমিটিকে দু’ভাগ করল সিপিএম। তৈরি হল ১৩ সদস্যের দু’টি কমিটি। দুই কমিটির নেতৃত্বে দুই ষাটোর্ধ্ব, সুপরিচিত নেতা। তবে নতুন সদস্যরা প্রায় সকলেই বয়সে নবীন, দলে আনকোরা। অধিকাংশই এসএফআই, ডিওয়াইএফআই থেকে লোকাল কমিটির সদস্য হলেন এই প্রথম। ফলে দুটি কমিটির ভাবমূর্তি মোটামুটি পরিচ্ছন্ন হলেও, রাজনীতির ময়দানে তার সদস্যরা কতটা কার্যকরী হবেন তা স্পষ্ট নয়।
কল্যাণ গুপ্ত, নবদ্বীপ জোনাল কমিটির সম্পাদক বলেন, “এই এলাকা পুনর্বিন্যাস জরুরি ছিল। বেশ কিছু পঞ্চায়েত না-শহর, না-গ্রাম হয়ে রয়ে যাচ্ছিল। সেই সঙ্গে, ২৪টি ওয়ার্ড নিয়ে তৈরি কমিটি দিয়ে কাজ করতেও সমস্যা হচ্ছিল। তাই দুটি কমিটি তৈরির সিদ্ধান্ত।” এ বার পুর এলাকার পাশাপাশি নবদ্বীপ-সংলগ্ন গ্রামাঞ্চলেও কার্যকরী হতে পারবে দল, আশা করছে সিপিএম।
একটানা ১৪ বছর ধরে নবদ্বীপে ক্ষমতাসীন রয়েছে তৃণমূল। বিরোধীর ভূমিকায় সিপিএম অনেকটাই নিষ্প্রভ ছিল নবদ্বীপে। এখন এই সক্রিয়তার কারণ কী? জেলার নেতারা একান্তে স্বীকার করলেন, সম্প্রতি বদলাতে শুরু করেছে এ রাজ্যের রাজনীতির অঙ্ক। তৃণমূল কংগ্রেসের বিকল্পের সন্ধানে বিজেপির দিকে ঝুঁকছে রাজ্যবাসী। যে সিপিএমের বিরোধিতা করে তৃণমূলের জন্ম, সেই তৃণমূল বিজেপিকে রুখতে এখন সিপিএম-এর প্রতি নরম ভাব দেখাচ্ছে। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘ফিশ ফ্রাই রাজনীতি’ প্রভাব ফেলেছে জেলাতেও। ফলে মিটিং-মিছিল সভা-সমিতিতে সিপিএমের বিরুদ্ধে তৃণমূলের আক্রমণের তীব্রতা এখন একটু একটু করে কমছে। সেই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে ফের সক্রিয় হয়ে উঠতে চাইছে সিপিএম। তাই এই নতুন উদ্যম।
তৃণমূলের দাপটে সিপিএমের যে কর্মীরা প্রায় অদৃশ্য হয়ে গিয়েছিলেন, তাঁরা আবার পরিস্থিতি বুঝে গুটিগুটি পায়ে দলীয় সভা সমিতিতে ভিড় করছেন। অফিসে, কারখানায়, পাড়ায় সিপিএম করার ‘অপরাধে’ আক্রান্ত হওয়া, মিথ্যা মামলার ভয়ে সিপিএমের কর্মীদের বাক্রোধ হয়ে গিয়েছিল, তাঁদের অনেকেই বিজেপির বাড়বাড়ন্তের সুযোগ নিয়ে তৃণমূল বিরোধিতায় সক্রিয় হয়ে উঠেছেন।
অন্য দিকে, তৃণমূলের সন্ত্রাস, তোলাবাজি, নারী নির্যাতন, সারদা কেলেঙ্কারিতে দলের সর্বোচ্চ স্তরের নেতাদের জড়িয়ে পড়ার পর রাজনৈতিক বিরোধিতার জমিও ফের শক্ত হচ্ছে। প্রকাশ্যে ছোটবড় সভা করছে প্রায় সব দলই। সারদা কেলেঙ্কারি নিয়ে নবদ্বীপ জুড়ে সিপিএমের যে প্রচারাভিযান শুরু হয়েছে, তাতে বক্তা হিসেবে তরুণ প্রজন্মকে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। ডিওয়াইএফআই-এর স্থানীয় নেতারাই ওই সব সভার প্রধান বক্তা হিসেবে থাকছেন। নতুন মুখের ভাষণ শুনতে ভিড়ও মন্দ হচ্ছে না।
কিন্তু বিজেপি মস্ত চ্যালেঞ্জ হয়েও দেখা দিয়েছে। মন্দিরশহর নবদ্বীপে বিজেপির একটা প্রভাব রয়েইছে। গত লোকসভা নির্বাচনে নবদ্বীপ পুরসভা এলাকায় কার্যত সংগঠনহীন বিজেপি সিপিএমকে পিছনে ফেলে দ্বিতীয় স্থানে উঠে এসেছে। সংগঠনহীন বিজেপির এই উত্থানে স্থানীয় সিপিএম এবং তৃণমূল উভয়েই অশনি সঙ্কেত দেখছে। এই অবস্থায় তৃণমূলের বিরুদ্ধে ক্রমবর্ধমান অসন্তোষের ফসল যাতে বিজেপি ঘরে তুলতে না পারে, তার জন্য কোমর বেঁধে ময়দানে নামতে চাইছে সিপিএম। সংগঠনকে ঢেলে সাজানো তারই পদক্ষেপ।
২০১৫ সালের মে মাসের মধ্যে যে কোনও সময়ে পুরভোট হতে পারে। তাই তৃণমূল-পরিচালিত নবদ্বীপ পুরসভার দুর্নীতি, স্বজনপোষণ, প্রোমোটারি, ব্যবসা ও দলবাজির বিরুদ্ধে তথ্য সম্বলিত প্রচারকেই দলের মূল হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহারের সিদ্ধান্ত নিয়েছে সিপিএম। ইতিমধ্যে দলের হাতে নবদ্বীপ পুরসভায় তৃণমূলের দুর্নীতির যে সব নির্দিষ্ট তথ্যপ্রমাণ এসেছে, সেগুলি জনগণের সামনে প্রকাশ করতে উত্সাহী সিপিএম-এর নবীন সদস্যেরা।
এ ভাবে শাসকদলের বিরুদ্ধে তথ্য প্রকাশ করলে হামলা হতে পারে, অথবা মিথ্যা মামলায় গ্রেফতার করা হতে পারে, সে ভয় থাকছেই। কিন্তু এখন জনমত যেদিকে, তাতে সিপিএম নেতাদের উপর হামলা হলে বা গ্রেফতার করা হলে জনমানসে বিরূপ প্রতিক্রিয়া হবে, যা নির্বাচনে তাঁদের পক্ষে যাবে, মনে করছে সিপিএম। পোড়-খাওয়া সিপিএম নেতৃত্ব এমন পরিস্থিতির কথা হিসেব করেই নবদ্বীপ লোকাল কমিটির সম্পাদকের দায়িত্ব দিয়েছে নবদ্বীপের প্রাক্তন পুরপ্রধান, অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক অমরেন্দ্রনাথ বাগচিকে। নবদ্বীপ দক্ষিণ লোকাল কমিটির সম্পাদকের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে আর এক অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক এবং পুরসভার প্রাক্তন উপপুরপ্রধান অজয় সিংহকে।
সিপিএমের অন্দরমহলের খবর সিপিএম ১৯ বছর টানা ক্ষমতায় থাকলেও, সিপিএমের কোনও পুরপ্রধান বা উপপ্রধানের বিরুদ্ধে দুর্নীতি বা স্বজনপোষণের তেমন জোরালো অভিযোগ ওঠেনি। ফলে পুরসভায় তৃণমূলের দুর্নীতির প্রসঙ্গ তুললে পাল্টা কোনও দুর্নীতির অভিযোগ তোলার সুযোগ শাসক দলের নেই। আবার দলের নতুন নেতারা আনকোরা হওয়ায় তাদের বিরুদ্ধেও অভিযোগ তোলা সহজ হবে না। সুবল কংসবণিকের মতো দুর্নীতি, সন্ত্রাসে অভিযুক্ত নেতারা এখন দলের বাইরে। এমন সব অঙ্ক কষেই ময়দানে নতুন করে নামছে সিপিএম।
বহু জেলায় জোনাল কমিটিকে ভেঙে নতুন লোকাল কমিটি গড়ছে দল। নবদ্বীপে জোনাল কমিটিকে এক রেখে, লোকাল কমিটিকে ভাগ করা হল। তাতে কতটা কাজ হয়, তাই এখন দেখার।
দুই লোকাল কমিটি
নবদ্বীপ
নবদ্বীপ পুরসভার ১ থেকে ১৬,২১ এবং ২২ নম্বর ওয়ার্ড ও বাবলারি গ্রাম পঞ্চায়েত এলাকা।
নবদ্বীপ দক্ষিণ
১৭ থেকে ২৪ নম্বর ওয়ার্ড (২১ ও ২২ বাদে) ও মহীশুরা এবং ফকিরডাঙা ঘোলাপাড়া পঞ্চায়েত।