চিনতে গিয়ে হার মেনে যেতে হয়!
ঝাঁজ ও গন্ধে মনে হতেই পারে কোনও নামী কোম্পানির দিশি বা বিলিতি মদ। বোতলের মান থেকে শুরু করে লেবেল, ছিপি সবই হুবহু নামকরা ব্র্যান্ডের মতো। আসল-নকলের তফাত বুঝতে গিয়ে হিমসিম খাচ্ছেন আবগারি দফতরের দুঁদে কর্তারাও। নদিয়া জেলার সীমান্তঘেঁষা বিভিন্ন এলাকায় এই নকল মদের রমরমা রুখতে লাগাতার অভিযানের সিদ্ধান্ত নিয়েছে জেলা আবগারি দফতর। নকল মদ যে তৈরির কথা কবুল করে ওই দফতরের সুপার দীপককুমার নাহা বলেন, “নিম্ন মানের স্পিরিট ব্যবহার করে নকল মদ তৈরি হচ্ছে। তার জন্য স্বাস্থ্য থেকে রাজস্ব সবকিছুর উপরেই খারাপ প্রভাব পড়ছে। নকল মদের বাড়বাড়ন্ত রুখতে আমরা অভিযানও চালাচ্ছি।”
সংগ্রামপুর বিষ-মদ কাণ্ডের পর কড়াকড়ির ফলে রাজ্যে চোলাই মদের রমরমা অনেকটাই কমেছে বলে দাবি আবগারি দফতরের। কিন্তু তার জায়গা নিয়েছে নকল মদের ব্যবসা। হাঁসখালি, বগুলা, মাজদিয়া, কৃষ্ণগঞ্জ ও নবদ্বীপের একাংশে নকল মদের কারবারীদের দৌরাত্ম্য সীমা ছাড়িয়েছে। গত এক বছরে জেলার বিভিন্ন এলাকা থেকে নকল মদের কারবারের সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে আবগারি দফতর ১৫ জনকে পাকড়াও করেছে। গত সোমবার রাতে আবগারি দফতরের পদস্থ কর্তা অনিমেশ মণ্ডলের নেতৃত্বে একটি দল মাজদিয়ার জয়ঘাটা-হালদারপাড়ায় হানা দিয়ে নকল মদের কারবারী বছর চল্লিশের তাপস বিশ্বাস ওরফে নকশালকে গ্রেফতার করে। সেই সঙ্গে বাজেয়াপ্ত করা হয় বোতল, স্পিরিট, ছিপি ও লেবেল। বৃহস্পতিবারেও ওই একই অভিযোগে মাজদিয়ার বাসিন্দা নির্মল রায়কে পুলিশ গ্রেফতার করে। সম্প্রতি মাজদিয়ার বাসিন্দা বছর উনিশের ভীমকে গ্রেফতার করে পুলিশ জানতে পারে যে, সে কিশোরদের ব্যবহার করে নকল মদের কারবার চালাত।
কিন্তু প্রত্যন্ত সীমান্ত এলাকায় নকল মদের এত রমরমা কেন? আবগারি দফতরের এক পদস্থ কর্তা জানান, জেলায় দিশি-বিলিতি মিলিয়ে মদের ১৭৭টি কাউন্টার রয়েছে। যা প্রয়োজনের তুলনায় অনেক কম। সীমান্ত লাগোয়া এলাকাগুলিতে কাউন্টারের সংখ্যা খুবই কম। ফলে চাহিদা মেটাতে প্রচুর বেআইনি মদের দোকান গজিয়ে উঠছে। সেই দোকানগুলির একাংশের সঙ্গে ‘চুক্তি’ করে মদের জোগান দেয় ওই নকল মদের কারবারীরা। তাছাড়াও সীমান্তের ওপারে বাংলাদেশেও ঘুরপথে অনেক সময় ওই নকল মদ পাচার করা হয় বলেও জানান ওই কর্তা।
আবগারি দফতর সূত্রে জানা গিয়েছে, মদ তৈরির প্রধান উপকরন স্পিরিট। সরকার নিয়ন্ত্রিত মদ তৈরির কারখানার দায়িত্বে থাকা আবগারি দফতরের পদস্থ কর্তারা স্পিরিটের জন্য কমিশনারের কাছে আবেদন করেন। সেই আবেদন মঞ্জুর হলে তবেই কোম্পানিগুলি বাইরে থেকে ইথাইল অ্যালকোহলযুক্ত স্পিরিট আমদানি করতে পারে। ভিন্ রাজ্য থেকে আমদানি করা ওই স্পিরিট ‘এক্সটা নিউট্রাল অ্যালকোহল’ নামে পরিচিত। কাঁচা এই ‘ওভারপ্রুফ স্পিরিট’-কে পানযোগ্য করার জন্য নির্দিষ্ট মাত্রায় পাতিত জল মিশিয়ে ‘আন্ডার প্রুফ’ করা হয়। তারপরেও নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষার ধাপ পেরিয়ে মদ বোতলবন্দি হয়। আর নকল মদ? ধৃতদের জেরা করে আবগারি দফতরের কর্তারা জানতে পেরেছেন, মিথাইল অ্যালকোহলযুক্ত (যা মানব দেহের পক্ষে ক্ষতিকর বলেই মত চিকিৎসকদের) স্পিরিট ঘুরপথে পৌঁছে যাচ্ছে সীমান্তের নকল মদের কারবারীদের কাছে। ওই স্পিরিটের সঙ্গে কোনও পরীক্ষা-নিরীক্ষা ছাড়াই ইচ্ছামতো জল, রং ও নানা রকম ‘ফ্লেভার’ মিশিয়ে তৈরি হচ্ছে দিশি ও বিলিতি মদ।
নকল মদের এই বাড়বাড়ন্তের আরও একটা কারণ খুঁজে পাচ্ছেন আবগারি দফতরের কর্তারা। তাঁরা জানান, মদ প্রস্তুতকারক সংস্থাগুলিকে প্রতি ধাপে সরকারকে রাজস্ব দিতে হয়। কিন্তু নকল মদ তৈরির ক্ষেত্রে সে বালাই নেই। দফতর সূত্রে জানা গিয়েছে, ২০১২-১৩ আর্থিক বর্ষে দফতরের আদায়ীকৃত রাজস্বের পরিমাণ ছিল ১৫৪ কোটি। চলতি আর্থিক বর্ষে ২৪৫ কোটি টাকা রাজস্ব আদায় হয়েছে। সুপার দীপককুমার বলছেন, “নকল মদের এই রমরমা না থাকলে আরও অন্তত ৫০ কোটি টাকা বেশি রাজস্ব আদায় হত।” রাজস্ব ঘাটতির পাশাপাশি স্বাস্থ্য নিয়েও উদ্বিগ্ন প্রশাসন। নদিয়ার ডেপুটি সিএমওএইচ (১) প্রদীপকুমার দাস বলেন, “নকল মদে ব্যবহৃত মিথাইল অ্যালকোহল একরকমের বিষ। শরীরের লিভার ও কিডনি মারাত্মক ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়।”
আবগারি দফতরের অভিযানে সামিল হয়েছে জেলা পুলিশও। নদিয়ার পুলিশ সুপার অর্ণব ঘোষ বলেন, “আবগারি দফতরের সঙ্গে যৌথ ভাবে নকল মদের কারবার রুখতে আমরা বিভিন্ন জায়গায় হানা দিচ্ছি।”
অনেকে গ্রেফতার হচ্ছে, উদ্ধার হচ্ছে নকল মদ-সহ নানা উপকরণও। কিন্তু সাধারণ মানুষকে নকল মদ নিয়ে সচেতন করতে কি কোনও পদক্ষেপ করা হচ্ছে? প্রশাসনের তরফে তেমন কোনও সদুত্তর কিন্তু মেলেনি।
নকল বৃত্তান্ত
বেআইনি ভাবে নিয়ে আসা হচ্ছে মিথাইল অ্যালকোহলযুক্ত স্পিরিট।
নকল মদের রং, বোতলের লেবেল হুবহু একই রকম দেখতে।
এই মদের রমরমা বাড়ছে সীমান্ত এলাকায়।
রাজস্ব কমছে আবগারি দফতরের।
নকল মদের কারবারে জড়িত থাকার অভিযোগে গত এক বছরে ১৬ জনকে গ্রেফতার।