গ্রাম নয়, পুরসভা। এমনই কাঁচা রাস্তা বহাল রয়েছে এখনও। গৌতম প্রামাণিকের তোলা ছবি।
আয়তন মাত্র ১৩ বর্গ কিলোমিটার। অথচ ওইটুকু চৌহদ্দির মধ্যেই রয়েছে তিন তিনটে রাজবাড়ি— কান্দি।
রাজ্য মন্ত্রিসভার দু’জন সদস্য আর বিধানসভার দু’বারের বিরোধী দলনেতা থেকে বিশিষ্ট বিজ্ঞানী বিকাশ সিংহ—সকলকেই পেয়েছে এই ছোট্ট শহর। রাজবাড়ির নাটমঞ্চ উদ্বোধন করতে পা রেখেছিলেন বিদ্যাসাগর, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের অন্তরঙ্গ বন্ধু তথা উনিশ শতকের নবজাগরণের অন্যতম পুরোধা পুরুষ রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদীও এই শহরের ভূমিপুত্র। এক সময় এখানের ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট ছিলেন মদনমোহন তর্কালঙ্কার। মহাকুমাশাসক ছিলেন দ্বিজেন্দ্রলাল রায়। সাহিত্যিক অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্তও ছিলেন মুন্সেফ।
আজও এই শহরে পিচ-পাথরের বদলে রয়েছে মাটির কাঁচা রাস্তা। বিশাল অট্টালিকার পাশেই রয়েছে কাদামাটির দেওয়াল আর খড়ের চালার কুঁড়েঘর।
১৫৯৬ সালে কান্দি মহকুমার আতাই-শেরপুর গ্রামে সম্রাট আকবরের সেনাপতি মান সিংহের সঙ্গে যুদ্ধ বাধে বাংলার আফগান শাসক কতলু খাঁর। বাংলায় মুঘল শাসনের পত্তন হয়। ওই যুদ্ধে মান সিংহকে প্রভূত সাহায্য করেছিলেন কান্দির বাঘডাঙার কাচু (ত্রিপুরেন্দ্রনারায়ণ রায় চৌধুরী) রাজাদের পূর্বপুরুষ। কৃতজ্ঞতায় মান সিংহও তাঁদের প্রভূত ধন-সম্পত্তি দান করেন। ‘কান্দি প্লিডার্স অ্যান্ড অ্যাডভোকেটস বার অ্যাসোসিয়েশন’-এর সম্পাদক সফিউর রহমান বলেন, “বাঘডাঙার রাজবাড়ির পত্তন হয় সেই থেকে।” তার বেশ পরে প্রতিষ্ঠা পায় রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদীর নিকট আত্মীয়দের রাজত্ব। কান্দির জেমো রাজা বলেই তাঁরা পরিচিত।
কৃষ্ণচন্দ্র সিংহের পৌত্র গঙ্গাগোবিন্দ সিংহ ছিলেন ওয়ারেন হেস্টিংসের মুন্সি। পরে তিনি রাজত্ব পান। গঙ্গাগোবিন্দ সিংহ ও তাঁর বংশধরদের বলা হয় ‘কান্দির রাজা’। তাঁর অত্যাচারের তুলনা করা হয় লালবাগ লাগোয়া নশিপুরের ‘ডাকাত রাজা’ দেবী সিংহের নৃশংসতার।
ওই তিন রাজাবাড়ির রাজত্বকালে ১৮৬৯ সালে মুর্শিদাবাদ জেলায় প্রথম ২টি পুরসভার অনুমোদন মেলে। একটি কান্দি। অন্যটি জঙ্গিপুর। ১৯২১ সালের আগে কান্দি পুরসভায় কোনও নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি ছিল না। পুরসভা পরিচালনা করতেন মহকুমাশাসক। ১৯২১ সালে পুরসভার প্রথম নির্বাচন। প্রথম নির্বাচিত পুরপ্রধান হন শরৎচন্দ্র সিংহ। তাঁর আমলে জেমো রাজবাড়ি ও রাজবাড়ি লাগোয়া এলাকা কান্দির পুরসভার অন্তর্ভুক্ত হয়।
এখন আর সেই রাজা নেই। জল-জঙ্গলে ভরা হিজলও আগের সেই হিজল নেই। তার চরিত্র পাল্টেছে। বাঘও নেই। ৬-৭ ফুট উঁচু বেনা ঘাসের সেই ঘন নিবিড় বন নেই। হিজল থেকে বেনা ঘাসের বন উধাও হওয়ার সঙ্গেই উধাও হয়েছে কান্দির মিষ্টান্নের অতীত সুখ্যাতি। পুরসভা হলেও কান্দি শহরে বাস করে বিশাল সংখ্যক গোপালক পরিবার। তার কারণ, কাছে হিজলের মতো গোচারণ ক্ষেত্র থাকার সুবিধা। মুর্শিদাবাদ জেলা কংগ্রেস কমিটির অন্যতম সম্পাদক শাশ্বত মুখোপাধ্যায়ের বাড়ি কান্দি পুরসভা এলাকায়। তিনি বলেন, “সুপ্রসিদ্ধ সুগন্ধি তৈরি হয় বেনে ঘাসের শিকড় থেকে। হিজলের সেই সুগন্ধি বেনে ঘাস খাওয়ার কারণে এ তল্লাটের গরুর দুধ, মাখন, ছানা, দই, মোয়া একদা অন্য এলাকার থেকে খুবই সুস্বাদু ছিল। হিজলের সেই বেনে ঘাসের বন অবলুপ্ত হওয়ায় হারিয়ে গিয়েছে গোদুগ্ধজাত কান্দি শহরের মিষ্টান্নের সেই খ্যাতিও।”
একটি মত অনুসারে প্রথমে ৯টি ওয়ার্ড নিয়ে কান্দি পুরসভা গঠিত হয়। কিন্তু প্রয়াত রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদীর লেখা থেকে জানা যায়, প্রথমে ৫টি ওয়ার্ড নিয়ে কান্দি পুরসভার পথ চলা শুরু ১৮৬৯ সালে। সেই কান্দির বর্তমানে ওয়ার্ড সংখ্যা ১৭। আয়তন ১২.৯৭ বর্গ কিলোমিটার। ২০১১ সালের গণনা অনুসারে কান্দি পুর এলাকার জনসংখ্যা ৫৫ হাজার ৬৩১। পুরসভার সূত্রে জানা গিয়েছে, গত শতাব্দীর নব্বইয়ের দশকে এই শহরে পিচ-পাথরের সড়ক ছিল ৫০ কিলোমিটার আর মাটির কাঁচা রাস্তা ছিল ১৭ কিলেমিটার। পুরপ্রধান কংগ্রেসের গৌতম রায়ের দাবি, “২০১০-২০১১ সালে সমীক্ষার হিসাব অনুসারে শহরে পাকা সড়কের পরিমাণ ১২৯ কিলোমিটার। শহরে বর্তমানে কাঁচা রাস্তা নেই। রূপপুর থেকে বাঘডাঙা মোড় পর্যন্ত ৩ কিলোমিটার দীর্ঘ একটি নতুন রাস্তা করার প্রকল্প নেওয়া হয়েছে। বর্তমানে কেবল ওই রাস্তাতে পিচ পাথর পড়েনি। শীঘ্রই ওই কাঁচা রাস্তাটি পিচ পাথর দিয়ে মুড়ে দেওয়া হবে।” পুরপ্রধানের সঙ্গে অবশ্য একমত নন শহরের ১২, ১৩ এবং ৬ নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দারা। ওই ওয়ার্ড গুলির মধ্যে নপাড়া, বোয়ালিয়া, ঘাসিপাড়া, রাজাদিঘিরপাড়া ও ছকুুপাড়ার কাঁচা অথবা মোরাম বিছানো রাস্তায় আজ পর্যন্ত পিচ-পাথর পড়েনি। গ্রীষ্মে ধুলোর ঝড় ও বর্ষায় কাদা মাখামাখি হতে হয় দেড়শো বছরের প্রাচীন শহরের ওই এলাকার বাসিন্দাদের। হতদরিদ্রদের মাথা। পাকা ছাদ করে দেওয়ার জন্য সরকারি বিভিন্ন প্রকল্প রয়েছে। কিন্তু তা কেবল খাতা কলমেই। নইলে কান্দি পুরসভার ১ নম্বর ওয়ার্ডের মোহনবাগান ও ১১২ নম্বর ওয়ার্ডের শিবরামবাটী এলাকায় আজও কেন হতদরিদ্রদের মাথার উপর পাকা ছাদ জোটেনি। তাঁরা বাস করেন মাটির দেওয়াল ও খড়ের চালার কুঁড়েঘরে। উন্নয়নের ছোঁয়া না লাগা ওই সব তল্লাটে বাস করেন সংখ্যালঘু ও তপসিলি সম্প্রদায়ের দরিদ্রতর শ্রেণির মানুষজন। তাঁদের প্রতি পুরপ্রধানের আশ্বাস, “কাঁচা রাস্তা পিচের করা হবে। গরিবের মাথায় ছাদও উঠবে। তবে আস্তে আস্তে।”