বিড়ি হাসপাতালে পড়ে থেকে নষ্ট হচ্ছে অ্যাম্বুল্যান্স। —নিজস্ব চিত্র।
পুরসভায় উন্নীত হলে হয়তো নাগরিক পরিষেবার সামান্য উন্নতি ঘটত। স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলিতে হয়তো দেখা মিলত চিকিৎসকের। কিন্তু শহর হিসেবে গড়ে উঠলেও শহরের মর্যাদা আজও জোটেনি অরঙ্গাবাদের। তাই মানুষের বসতি বাড়লেও সেই তুলনায় বাড়েনি নাগরিক পরিষেবা। স্বাস্থ্য, নিকাশি, কিংবা পানীয় জলের পরিষেবা সবেতেই যেন ক্রমশ পিছিয়ে পড়ছে অরঙ্গাবাদ।
শহরের বেশিরভাগ মানুষের আয়ের উৎস বিড়ি বাঁধাই। তাই শহরে তামাকজনিত রোগে আক্রান্তদের সংখ্যাও লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে। এক সর্ব ভারতীয় স্বাস্থ্য সংস্থার সমীক্ষায় জানা গিয়েছে, অরঙ্গাবাদের ৯৮.৮ শতাংশ মানুষ বাড়িতে বসেই বিড়ি বাঁধাইয়ের কাজ করেন। তাঁদের মধ্যে ৯৩.৪৭ শতাংশ মানুষ একই ঘরে শোওয়া, বসা ও বিড়ি বাঁধাইয়ের কাজ করেন। তাঁদের মধ্যে এক মাসেরও বেশি সময় ধরে রোগে ভুগছেন ২৪.৮ শতাংশ শ্রমিক। ৬ মাস ধরে রোগে ভুগছেন ৪২ শতাংশ শ্রমিক। ১১ মাস ধরে অসুস্থ ১৪.১১ শতাংশ মানুষ। আর এক বছরের বেশি সময় ধরে অসুস্থ মানুষের সংখ্যা ১৯.৬৫ শতাংশ। আবার তাঁদের মধ্যে একটি মাত্র রোগের শিকার ৫.২৬ শতাংশ শ্রমিক। তিনটির বেশি রোগে আক্রান্ত ৬৪.৯১ শতাংশ মানুষ। চারটি বা তার বেশি রোগে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ২৯.৮২ শতাংশ। বছরে অন্তত দু’বার অসুস্থ হন ৫৩.৮৭ শতাংশ শ্রমিক। চার বার বা তার বেশি সময় অসুস্থতার কবলে পড়েন ৪৬.১৩ শতাংশ মানুষ। অসুস্থতা বলতে কাশি, শ্বাসকষ্ট, যক্ষা, চর্মরোগ, হাঁপানি, স্পন্ডেলোসিস, ও থ্রোট ক্যান্সারই প্রধান। সমীক্ষায় জানা গিয়েছে ওই রোগের প্রধান উৎস মূলত তামাক। এর মধ্যে থ্রোট ক্যান্সার ও হাঁপানিতে মারা যান অন্তত শতকরা ৮৫ জন। পরিস্থিতি যখন এমনই তখন শহরের স্বাস্থ্য পরিষেবা কেমন?
খাতায় কলমে অরঙ্গাবাদে দু’টি সরকারি স্বাস্থ্যকেন্দ্র রয়েছে। দু’টিই নিমতিতা স্টেশন লাগোয়া ডিহিগ্রামে। একটি কেন্দ্রীয় শ্রম মন্ত্রকের বিড়ি শ্রমিক কল্যাণ পর্ষদের আওতায়। অন্যটি রাজ্যের স্বাস্থ্য দফতরাধীন অরঙ্গাবাদ প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্র। কিন্তু বিড়ি শ্রমিকদের জন্য তৈরি হাসপাতালে কোনও চিকিৎসক নেই। অরঙ্গাবাদ প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রে একজন চিকিৎসক থাকলেও সব দিন তাঁর দেখা মেলে না বলে অভিযোগ। সিটুর জেলা সভাপতি আবু হাসনাত খান দীর্ঘদিন সাংসদ ছিলেন ওই এলাকার। তিনি জানান, অরঙ্গাবাদের নিমতিতা বিড়ি শ্রমিক কল্যাণ পর্ষদের হাসপাতালটি আগে ছিল রাজ্য স্বাস্থ্য দফতরের অধীনে। বিড়ি শ্রমিকের সংখ্যাধিক্যের কারণে ১৯৭৮ সালে ওই হাসপাতালটিকে বিড়ি শ্রমিকদের চিকিৎসার সুবিধার জন্য কেন্দ্র ও রাজ্যের মধ্যে সমঝোতার ভিত্তিতে কেন্দ্রীয় শ্রম মন্ত্রককে হস্তান্তর করা হয়। এরপর তারই পাশে রাজ্য সরকার আর একটি ১০ শয্যার প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্র তৈরি করা হয়। উদ্দেশ্য ছিল অরঙ্গাবাদের চিকিৎসা পরিকাঠামোকে সুদৃঢ় করা। কিন্তু বাস্তবে তা হয়নি বলে তাঁর অভিযোগ। তিনি বলেন, “১০ শয্যার পাট চুকেছে কবেই। নিমতিতার বিড়ি শ্রমিক কল্যাণ পর্ষদের হাসপাতালেও চিকিৎসক নেই অনেক দিন ধরে।” স্থানীয় বাসিন্দা বছর একান্নর সামসুল শেখের ক্ষোভ, বিশাল এলাকা জুড়ে দু’দুটো সরকারি হাসপাতাল থাকলেও তা কোনও কাজে আসছে না। তিনি বলেন, “সামান্য কিছু হলে তাই গ্রামীণ চিকিৎসকই ভরসা।” জঙ্গিপুরের ভারপ্রাপ্ত মহকুমা স্বাস্থ্য আধিকারিক শাশ্বত মণ্ডল বলেন, “চেষ্টা হচ্ছে অরঙ্গাবাদ প্রাথমিক স্বাস্থ্য কেন্দ্রটিকে ফের ১০ শয্যার হাসপাতাল হিসেবে সাজিয়ে তোলার। একজন চিকিৎসক সেখানে রয়েছেন। আরও দু’জন চিকিৎসককে সেখানে নিয়োগ করা হবে। তাঁরা কাজে যোগ দিলেই স্বাস্থ্যকেন্দ্রটিতে অন্তর্বিভাগ চালু করে দেওয়া হবে।”
সমস্যা রয়েছে পানীয় জলেরও। বর্তমানে এলাকার মানুষের পানীয় জলের উৎস বলতে মূলত ভূগর্ভস্থ নলকূপ। এলাকায় জনস্বাস্থ্য ও কারিগরি দফতরের যে কয়েকটি জল প্রকল্প রয়েছে তার সবগুলিই ভূগর্ভস্থ। কিন্তু সেই জলের বিশুদ্ধতা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে খোদ জনস্বাস্থ্য ও কারিগরি দফতরের রিপোর্টেই। রিপোর্টে জানা গিয়েছে, অরঙ্গাবাদের জগতাই-১, ২ ও অরঙ্গাবাদ-২ এলাকায় ভূগর্ভস্থ পানীয় জলে মারাত্মক পরিমাণে আর্সেনিক মিশে রয়েছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (হু)-র মতে, মানব শরীরে আর্সেনিকের সহ্যমাত্রা প্রতি লিটার জলে .০১ মিলিগ্রাম ও বুর্যো অফ ইন্ডিয়ান স্ট্যান্ডার্ড অনুযায়ী .০৫ মিলিগ্রাম। কিন্তু অরঙ্গাবাদের বিভিন্ন এলাকায় জলে আর্সেনিকের মাত্রা তার চেয়ে অনেক উপরে। যেমন জগতাই ১-এ বেশির ভাগ এলাকায় জলে আর্সেনিকের মাত্রা .০১ থেকে .০৫ মিলিগ্রাম হলেও ২৫.৯ শতাংশ এলাকায় আর্সেনিকের পরিমাণ .০৫ থেকে .১০ মিলি গ্রাম। কোথাও কোথাও সেই মাত্রা .১৮ মিলি গ্রামের উপরে। ভয়াবহ অবস্থা জগতাই-২ পঞ্চায়েত এলাকায়। ওই পঞ্চায়েতের বেশিরভাগ এলাকায় জলে আর্সেনিকের মাত্রা .০১ থেকে .০৫ মিলিগ্রাম। ১১.৯ শতাংশ এলাকায় প্রতি লিটার জলে .০৫ থেকে .১০ মিলিগ্রাম আর্সেনিক মিশে রয়েছে। কোথাও কোথাও সেই মাত্রা .১৬ মিলিগ্রামের উপরে। অরঙ্গাবাদ-২ পঞ্চায়েতের বাসিন্দারা একই ভাবে আর্সেনিকপ্রবণ এলাকায় রয়েছেন। কোথাও কোথাও সেই মাত্রা .২৪ মিলিগ্রামের উপরেও। অরঙ্গাবাদের সরকারি স্তরে পানীয় জল ও স্বাস্থ্য ব্যবস্থা যে খুবই বেহাল তা স্বীকার করে নেওয়া হয়েছে রাজ্য মানবাধিকার কমিশনের এক রিপোর্টেও। পানীয় জলে আর্সেনিকের ব্যাপক উপস্থিতি অজানা নেই স্থানীয় বাসিন্দাদেরও। আর সেই সুযোগকে কাজে লাগিয়েছেন এক শ্রেণির ব্যবসায়ী। তাঁরা দেদার বিক্রি করছেন ২০ লিটারের ‘মিনারেল ওয়াটার’-এর জ্যারিকেন। কিন্তু সেই জলও কতটা শুদ্ধ তা নিয়ে সন্দেহ থেকে যাচ্ছেই।
জগতাই-১ পঞ্চায়েতের প্রধান যাদব সিংহ জানান, সবর্ত্রই ভূপৃষ্ঠের জলকে পরিশোধন করে দৈনন্দিন কাজে লাগানো হচ্ছে। অরঙ্গাবাদের পাশ দিয়েই বয়ে গেছে গঙ্গা। সেই জলকে আর্সেনিক মুক্ত পানীয় জল হিসেবে ব্যবহার করার সুবিধা নিয়েছেন রাজ্যের গঙ্গাপাড়ের সমস্ত শহর। কিন্তু অরঙ্গাবাদে গঙ্গার জলকে কাজে লাগিয়ে জল প্রকল্প গড়ে তোলার সুবিধা থাকলেও সে ব্যাপারে কোনও পদক্ষেপ করতে দেখা যায়নি প্রশাশনকে। তাঁর ক্ষোভ, অরঙ্গাবাদ শহর হলে জল ও স্বাস্থ্য দুই ক্ষেত্রেই মানুষ কিছুটা হলেও স্বাচ্ছন্দ্য পেতেন। তিনি বলেন, “বাড়িতে অতিথি এলে ঘরের জল দিতে এখন সঙ্কোচ হয়। আমার মতো অনেকেই কেনা জলের বোতল তুলে দেন অতিথিদের হাতে।”
বিড়ি ছাড়াও এক সময়ে বাজির জন্য সুনাম ছিল অরঙ্গাবাদের। হরেক রকম বাজি অরঙ্গাবাদ থেকে রাজ্যের বিভিন্ন বাজারে যেত। বিয়ে, পৈতে, অন্নপ্রাশন বা যে কোনও পুজোপাবর্ণের বাজির তৈরির জন্য বায়না পেতেন অরঙ্গাবাদের বাজি কারিগররা। বর্তমানে অরঙ্গাবাদের সেই সুদিন আর নেই। তবে বাজির ঐতিহ্য কিছুটা হলেও আঁকড়ে রয়েছেন দারিয়াপুর ও নতুন চাঁদরা। দারিয়াপুরের পঞ্চাশোর্ধ কলিমুদ্দিন শেখ (নাম পরিবর্তিত) বলেন, “ছোটবেলা থেকেই বাজির কারবার দেখে আসছি। বিয়ে, পুজোর মাসে নাওয়াখাওয়ার জন্যও সময় থাকত না কারওই। বাড়ির মেয়েরাও সমানে হাত লাগাত বাজি তৈরিতে।” তাঁর ক্ষোভ, “এখন বাজি নেই। বদলে এসেছে বোমা।” স্থানীয় বাসিন্দাদের ক্ষোভ, বর্তমানে বাজির নাম করে বারুদ ও মশলা এনে বোমা গড়ছে দুষ্কৃতীরা। তাই বেড়েছে পুলিশি উৎপাতও। নাম প্রকাশ্যে অনিচ্ছুক এক বাসিন্দার কথায়, “বোমা যেন এখন কুটির শিল্প।”
গত এক বছরে অরঙ্গাবাদ থেকে পুলিশ কয়েক হাজার বোমা উদ্ধার করেছে। পুলিশের এক পদস্থ কর্তা জানান, প্রস্তাবিত পুর এলাকার মধ্যে দু’একটি গ্রামে বোমাবাজি নিত্য দিনের ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। বেশ কয়েক জন খুনও হয়েছেন। শতাধিক দুষ্কৃতীর নামে একাধিক মামলা চলছে। স্থানীয় বাসিন্দাদের অভিযোগ, এক শ্রেণির রাজনৈতিক নেতাদের মদতে অবাধে ঘুরে বেড়াচ্ছে দুষ্কৃতীরা। প্রকাশ্যে মারপিট বা খুন জখমে করছে। আর এটাই হয়ে দাঁড়িয়েছে অরঙ্গাবাদের রোজকার জীবনে প্রধান মাথা ব্যাথার কারণ।
কেমন লাগছে আমার শহর? নিজের শহর নিয়ে
আরও কিছু বলার থাকলে আমাদের জানান।
ই-মেল পাঠান district@abp.in-এ।
subject-এ লিখুন ‘আমার শহর-নদিয়া মুর্শিদাবাদ’।
ফেসবুকে প্রতিক্রিয়া জানান:
www.facebook.com/anandabazar.abp
অথবা চিঠি পাঠান ‘আমার শহর’,
নদিয়া মুর্শিদাবাদ বিভাগ, জেলা দফতর
আনন্দবাজার পত্রিকা,
৬ প্রফুল্ল সরকার স্ট্রিট, কলকাতা ৭০০০০১