এই সেই রাস্তা। —নিজস্ব চিত্র।
একজোট হয়ে জমি দিয়ে রাস্তা তৈরির নজির গড়ল কান্দির কয়া গ্রামের বাসিন্দারা।
সহজে মহকুমা শহর কান্দিতে পৌঁছতে দরকার ছিল একটি রাস্তার। বহুদিন ধরে প্রশাসনের কাছে আবেদন নিবেদন করেও কোনও সুরাহা হচ্ছিল না। তাই শেষ পর্যন্ত নিজেরাই হাত লাগিয়েছেন রাস্তা তৈরির কাজে। কেউ ছেড়ে দিয়েছেন খাস জমি। কেউ বা জমি না দিতে পেরে বাড়িয়ে দিয়েছেন নগদ টাকা। পিছিয়ে নেই পঞ্চায়েতও। একশো দিনের কাজের শ্রমিকদের কাজে লাগিয়ে চলছে মাটি ফেলার কাজ। প্রায় এক কিলোমিটার রাস্তা শেষ হতে বেশি বাকি নেই। যাতায়াতের পাশাপাশি এলাকার সার্বিক উন্নতিতে গ্রামবাসীদের ওই প্রচেষ্টাকে তাই কুর্নিশ করছেন আট থেকে আশি।
রাস্তা যে একেবারেই ছিল না এমন নয়। কান্দি বাইপাস সংলগ্ন মাড়ুরোর মোড় থেকে কয়েম্বা, কয়া, শক্তিপুর ছুঁয়ে পাঁচথুপী পর্যন্ত একটি মোরামের রাস্তা রয়েছে। কিন্তু দীর্ঘদিন ধরে সেই রাস্তা সংস্কার না হওয়ায় যাতাযাতের অযোগ্য হয়ে উঠেছিল। মুর্শিদাবাদ জেলা পরিষদের অধীনে থাকা ওই রাস্তাটির সংস্কারের জন্য বহু বার আবেদন জানানো হলেও জেলা পরিষদ তাতে কর্ণপাত করেনি বলে অভিযোগ।
তাই কয়া গ্রামের বাসিন্দাদের মহকুমা শহর কান্দিতে যেতে হলে কান্দি-ডাকবাংলো রাজ্য সড়ক ধরে প্রায় নয় কিলোমিটার ঘুরে যেতে হত। তবে এ বার স্থানীয় সাংসদ অধীর চৌধুরীর হস্তক্ষেপে ওই রাস্তাটি সংস্কারের কাজ শুরু হয়েছে। শুধু তাই নয়, প্রধানমন্ত্রী গ্রাম সড়ক যোজনার অধীনে মোরাম রাস্তার বদলে পিচের রাস্তা তৈরি হচ্ছে। গ্রামবাসীরা জানান নিজেদের উদ্যোগে যে রাস্তা তাঁরা তৈরি করছেন তা ওই রাস্তার সঙ্গে মিশবে। তার ফলে কান্দি শহরে পৌঁছতে তাঁদের অর্ধেকেরও কম সময় লাগবে।
ওই এক কিলোমিটার রাস্তা তৈরি করতে কয়া গ্রামের ৮০টি পরিবারের মধ্যে ৩০টি পরিবারের জমি লাগছে। প্রায় দশ বিঘা জমি ছাড়তে হয়েছে ওই পরিবারগুলিকে। তবে ওই দশ বিঘা জমিতেই শেষ নয়, রাস্তাটি শেষ করতে গেলে লাগবে পাশের শক্তিপুর গ্রামের বাসিন্দাদের জমিও। সেই জমিও তাঁরা কিনে নিয়েছেন। ৩৭ হাজার টাকা কাঠা দরে প্রায় পাঁচ লক্ষ টাকা দিয়ে জমি কিনেছেন তাঁরা। সেক্ষেত্রে যাঁদের রাস্তার উপর দিয়ে ওই রাস্তা যায়নি তাঁদের কাছ থেকে টাকা নেওয়া হয়েছে। গ্রামের বাসিন্দা পেশায় দর্জি সুমঙ্গল মণ্ডল বলেন, “সব মিলিয়ে আমার সাড়ে সাত কাঠা জমি রয়েছে। রাস্তা তৈরিতে জমি লাগবে শুনে এক কথায় রাজি হয়ে যাই। রাস্তা তৈরিতে এক কাঠা জমি লাগছে ঠিকই কিন্তু রাস্তা তৈরি হলে তা প্রত্যেকের কাজে আসবে।” আরও এক বাসিন্দা দেবু মণ্ডল বলেন, “ওই জমি কিনতে যাঁর যেমন সাধ্য তিনি তেমন টাকা চাঁদা দিচ্ছেন।”
রাস্তা তৈরিতে কান্দি পঞ্চায়েত সমিতিও সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছে। একশো দিনের কাজের প্রকল্প থেকে ওই রাস্তা তৈরির মাটি ফেলার কাজ করছে। পরবর্তী কালে ওই রাস্তা মোরামের রাস্তা করা হবে বলেও জানান কান্দি পঞ্চায়েত কর্তৃপক্ষ। কান্দি পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি পেশায় শিক্ষক কংগ্রেসের সুকান্ত ত্রিবেদি জানান, গ্রামবাসীদের ওই উদ্যোগ সত্যিই প্রশংসনীয়। তাঁর কথায়, “এতে শুধু গ্রামের আর্থিক উন্নয়ন ঘটবে তা নয়। ছেলেমেয়েদের পড়াশোনার উন্নতিও ঘটবে।”
কয়া গ্রামের বাসিন্দাদের যোগাযোগের মাধ্যম বলতে সাইকেল বা মোটরবাইক। কৃষি নির্ভর ৮০টি পরিবার ওই গ্রামে বসবাস করে। গ্রাম থেকে প্রায় দু’কিলোমিটার দূরে কান্দি-ডাকবাংলা রাজ্য সড়ক। বাস ধরতে গেলে ওই দুই কিলোমিটার রাস্তা হাঁটা ছাড়া অন্য কোনও উপায় নেই। আবার বাসে উঠে কান্দি যেতে গেলে প্রায় আট কিলোমিটার রাস্তা উজিয়ে যেতে হয়। ওই গ্রামের ছাত্রছাত্রীদের স্কুলে পৌঁছতে হলেগেলেও প্রায় পাঁচ কিলোমিটার রাস্তা পেরিয়ে বহড়া আদর্শ বিদ্যাপীঠে যেতে হয়। তাই অনেকে কোনও মতে মাধ্যমিক পর্যন্ত পড়াশুনো করে পড়াশোনায় আগ্রহ হারাতেন। নতুন রাস্তায় সেই আগ্রহ বাড়বে বলে গ্রামবাসীরা আশা।
ওই রাস্তাটি হলে শুধু গ্রামের শিক্ষার প্রসার ঘটবে এমন নয়। কৃষিপ্রধান ওই গ্রামের বাসিন্দাদের দাবি গ্রামের খেতের ফসল বাজারে বিক্রি করার কোনও উপায় নেই। গ্রামে কোনও গাড়ি ঢোকেনা। তার জন্য চাষিরা ফসলের ন্যায্য দাম পেতেন না। এ বারে শহরে গিয়ে খেতের সব্জি বা ফসল বিক্রি করতে পারবেন। এতে গ্রামের অর্থনৈতিক উন্নতি হবে। একই ভাবে স্বাস্থ্য পরিষেবাও হাতের মুঠোর মধ্যে আসবে বলে দাবি বাসিন্দাদের।