- ২০০৯ সালে কংগ্রেসের চিন্তন শিবিরে প্রণব। কৃষ্ণনগরে। ছবি: সুদীপ ভট্টাচার্য - ফাইল চিত্র
নদিয়ার রাজনীতিতে তাঁর নির্দিষ্ট কোনও ‘লবি’ ছিল না। ছিল না একেবারে নিজস্ব লোক বলতে যা বোঝায়, তেমনও কেউ। সকলের জন্যই প্রণব মুখোপাধ্যায়ের দরজা ছিল খোলা। কংগ্রেসের সকলেই ছিলেন তাঁর স্নেহের। তবে কাউকে কাউকে একটু বেশিই স্নেহ করতেন, সেটাও সত্যি।
নদিয়া জেলায় যে সব নেতারা প্রণববাবুর অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ ছিলেন, তাঁদের অন্যতম রানাঘাট কেন্দ্রের সাংসদ তথা প্রাক্তন মন্ত্রী আনন্দমোহন বিশ্বাস। তাঁকে ঘিরে অনেক সময়েই জেলার অন্য নেতাদের সঙ্গে প্রণববাবুর মতপার্থক্য হয়েছে। কখনও কখনও তা তিক্ততার পর্যায়ে পৌঁছেছে। কিন্তু ব্যক্তিসম্পর্কে ফাটল ধরেনি। জেলায় প্রণববাবুর ঘনিষ্ঠদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন কৃষ্ণনগরের চাষাপাড়া এলাকার বসিন্দা বিশ্বরূপ মুখোপাধ্যায়। এঁদের বাইরে এক সময়ে যে সব কংগ্রেস নেতারা তাঁর ঘনিষ্ঠ ও স্নেহধন্য ছিলেন, আজ তাঁরা অনেকেই তৃণমূলে। সেই তালিকায় আছেন অজয় দে, শঙ্কর সিংহ, গৌরীশঙ্কর দত্ত, উজ্জ্বল বিশ্বাসেরা। সোমবার সন্ধ্যায় প্রণববাবুর মৃত্যু সংবাদ পাওয়ার পরে গৌরীবাবু বলেন, “উনি ছিলেন আমাদের কাছে পিতৃপুরুষের মতো। চোখের সামনে কত স্মৃতি একের পর ভেসে উঠছে।”
প্রণববাবুর মৃত্যু সংবাদে কার্যত ভেঙে পড়েছেন অজয় দে। ২০১৩ সালের জুনে শেষ বার রাষ্ট্রপতি ভবনে দেখা করতে গিয়েছিলেন তিনি। রাষ্ট্রপতি ভবনের বিশাল লাইব্রেরির ভিতরে প্রায় ১৫ মিনিট ধরে প্রণববাবু তাঁর কাছে খুঁটিয়ে জানতে চেয়েছিলেন বাংলার রাজনীতি। বুঝতে চেয়েছিলেন কংগ্রেস নেতাদের অবস্থান। অজয়বাবু বলছেন, “উনি যখন প্রদেশের সভাপতি, আমি তখন জেলা সভাপতি। ২০০৯ সালে তিনি তাপস পালের হয়ে কালীগঞ্জ ও চাপড়ায় জনসভা করেছিলেন। ২০১১ সালে বিধানসভা ভোটে সনিয়া গাঁধীর সঙ্গে প্রণববাবুও আমার হয়ে শান্তিপুরে জনসভা করে গিয়েছেন।”
অজয় দে-র মনে পড়ছে, “২০১০ সালে পুর নির্বাচনে শান্তিপুরে ওঁর জনসভা করতে আসার কথা। বের হওয়ার মুখে প্রদেশ অফিসে তিনি আক্রান্ত হলেন। তার পরেও এসেছিলেন।” প্রণববাবুর প্রসঙ্গ তুলতেই বলে যান একের পর এক কত ঘটনা। বলেন, “মানুষটা ছিলেন গোষ্ঠী রাজনীতির ঊর্দ্ধে। কোনও দিন দল আর ব্যক্তি সম্পর্ককে এক করে ফেলেননি।”
নদিয়া জেলার কংগ্রেস ছিল বরাবরই সোমেন মিত্র ও প্রিয়রঞ্জন দাশমুন্সির মধ্যে বিভক্ত। এমনকি মমতা-সোমেনের লড়াইয়েও এই জেলা সোমেনের পাশে থেকেছে। এই দুই নেতার বাইরে প্রণববাবুর নিজস্ব কোনও গোষ্ঠী ছিল না। অনেকেই সংগঠনের প্রয়োজনের বাইরে নিজের এলাকা উন্নয়নের প্রয়োজনে তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ রাখতেন। তাঁর দিল্লির বাডিতে গিয়ে নিজেদের এলাকার বিভিন্ন প্রকল্পের অনুমোদনের ব্যবস্থা করে আসতেন। তবে ২০০৪ সালে প্রণববাবু মুর্শিদাবাদের রঘুনাথগঞ্জে প্রার্থী হওয়ার পর থেকে পরিস্থিতি বদলে যেতে থাকে। কারণ যাতায়াতের পথে তিনি নদিয়ায় থামতেন। দেখা করতেন জেলার নেতাদের সঙ্গে। ২০০৯ সালে আবার প্রার্থী হওয়ার পর সেই যোগাযোগ আরও বেড়ে যায়। তা ছাড়া তিনি তখন প্রদেশ সভাপতি। সাংগঠনিক কারণেও জেলার নেতাদের সঙ্গে তাঁর যোগাযোগের প্রয়োজন হতে থাকে।
বর্তমানে জেলা পরিষদের সভাধিপতি, তৃণমূলের রিক্তা কুণ্ডু বলে্ন,, “আমরা তৃণমূলে যোগ দেওয়ার আগে দিল্লিতে গিয়ে প্রণববাবুর সঙ্গে দেখা করে আসি। সবটা শোনার পরে সে দিন কিন্ত তিনি আমাদের কংগ্রেস ছাড়তে বারণ করেননি।” রাষ্ট্রপতি ভবনে গিয়ে তিনি দেখা করেছিলেন ২০১৬ শেষ বার বিধানসভা ভোটের পর। আর সভাধিপতি হওয়ার পর ফোন করেছিলেন প্রণববাবুকে। রিক্তাদেবী বলেন, “সে দিন জেলার সকলের কথা একে একে জানতে চেয়েছিলেন উনি। ওঁর স্মৃতিশক্তি দেখে অবাক হয়ে গিয়েছিলেন।” এখন তিনিই রইলেন অগণিত জনের স্মৃতিতে।