চলছে রাস্তা অবরোধ। খড়গ্রামে কৌশিক সাহার তোলা ছবি।
আন্দোলন তখন প্রায় শেষের পথে। দূরে একটি দোকানে দাঁড়িয়ে হাঁফ ছাড়ছেন পঞ্চায়েত প্রধান। কারণ আন্দোলনের অন্যতম লক্ষ তো তিনিই। কিন্তু বিধি বাম হলে যা হয়। চোখে পড়ল লাঠি হাতে আন্দোলনে নামা প্রমিলা বাহিনীর।
তার পর যা ঘটল তাকে প্রায় সিনেমার শেষ দৃশ্য বলা যায়। পুলিশের হস্তক্ষেপে কোনওমতে মারধর থেকে বাঁচলেও, অব্যাহতি মিলল না। মহিলারা তাঁকে লছিমনে তুলে সটান হাজির হলেন বিডিও অফিসে। খড়গ্রামের পঞ্চায়েতের প্রধান সরিফুল ইসলাম কাঁচুমাচু মুখে বিডিওর সামনে পঞ্চায়েতের থমকে থাকা উন্নয়নের কাজ শুরুর আশ্বাস দিয়ে ছাড় পান।
শনিবার খড়গ্রাম পঞ্চায়েত এলাকায় ঘটল এমন ঘটনা। সদস্যদের ধারাবাহিক দলবদলের জেরে গত দু’ বছর ধরে এই পঞ্চায়েত এলাকায় কোনও উন্নয়নই হয়নি।
পঞ্চায়েত প্রধানের চেয়ার যেন মিউজিক্যাল চেয়ার। আজ একজন তো কাল আর এক জন। পঞ্চায়েতের সদস্যরাও তাই, আজ সিপিএমে তো কাল কংগ্রেসে, পরশু তৃণমূলে। ফলে প্রায় দু’ বছর ধরে থমকে পঞ্চায়েতের উন্নয়নের কাজ। টাকা এসে ফিরে যাচ্ছে। আর পাড়ার খারাপ হয়ে যাওয়া টিফবওয়েল, সেই খারাপই রয়ে যাচ্ছে খড়গ্রাম পঞ্চায়েতের গ্রামগুলিতে।
শেষ পর্যন্ত জোরদার আন্দোলনে নামলেন এলাকার মহিলারা। শনিবার খড়গ্রামের প্রমিলা বাহিনী পঞ্চায়েত সদস্যদের বাড়িতে ভাঙচুর থেকে শুরু করে রাস্তা অবরোধ কিছুই বাদ রাখেননি। পঞ্চায়ের প্রধানকে একরকম তুলে বিডিও অফিসে নিয়ে গিয়ে শেষ পর্যন্ত পুলিশ তাঁদের বুঝিয়ে সুজিয়ে বাড়ি পাঠায়।
এই পঞ্চায়েতের ১৩টি আসনের মধ্যে নয়টি আসন কংগ্রেস, দু’টি তৃণমূল ও দু’টি আসনে সিপিএম জয়ী হয়েছিল। কিন্তু বোর্ড গঠনের আগেই কংগ্রেস ছেড়ে তৃণমূল যোগ দেয় কংগ্রেসের পাঁচ জন সদস্য। তার পর থেকে জনা কয়েক সদস্য কখনও কংগ্রেস, কখনও তৃণমূলে যোগ দিয়েছেন। বর্তমানে খাতায় কলমে পঞ্চয়েতে তৃণমুল সংখ্যাগরিষ্ঠ হলেও পর পর দু’বছর বাজেট পাশের সভা বয়কট করে। ফলে পঞ্চায়েতের টাকা এসেও ফিরছে। থমকে রয়েছে উন্নয়ন।
পঞ্চায়েতের রাস্তা কাদায় ভরা। সেখানে পিচ ঢালার প্রকল্প পাকা, কিন্তু তা হয়নি। অধিকাংশ নলকূপ অকেজো হয়ে পড়ে রয়েছে। এলাকার বাসিন্দাদের জল-কাদা ভেঙে দূর থেকে জল আনতে হয়। কাদা ভেঙেই যাতায়াত করতে হয় স্কুল কলেজের পড়ুয়াদের।
ফলে দলমত নির্বিশেষে গ্রামের বাসিন্দারা ক্ষোভে ফুটছিলেন। বলতে গেলে এদিনের প্রমিলা বাহিনীর আন্দোলন সেই ক্ষোভেরই বহিঃপ্রকাশ।
যদিও এদিনের আন্দোলনের মাস্টার প্ল্যান পুরুষদেরই তৈরি বলে জানিয়েছেন মহিলারা। তবে পুলিশি ঝামেলা-সহ বিভিন্ন হ্যাপা এড়াতে মহিলারাই রাস্তায় নামার সিদ্ধান্ত নেন।
প্রায় ৩০০ মহিলা এ দিন সকালে একজোট হয়ে বেড়িয়ে প্রথমেই ঘেরাও করে সিপিএম ছেড়ে তৃণমূলে যোগ দেওয়া পঞ্চায়েত সদস্য রেজাউল করিমের বাড়ি। তাঁকে না পেয়ে মহিলারা বাড়ি লক্ষ্য করে পাথর ছুড়তে শুরু করে। তাতে বাড়ির দরজা-জানালা ভেঙে যায়।
এর পরে তাঁরা হলদিয়া–ফরাক্কা বাদশাহি সড়কের উপর বসে পড়ে। তখন অঝোরে বৃষ্টি পড়ছে। কিন্তু তার মধ্যেই এই অবরোধ রাস্তায় যানবাহনের ভিড় বাড়ায়। খড়গ্রাম থানার পুলিশ অবরোধকারী মহিলাদের বিডিওর কাছে অভিযোগ জানানোর জন্য বোঝায়। বিডিও তাঁদের সমস্যা সুরাহার আশ্বাস দিলে অবরোধ ওঠে।
সেই সময় পঞ্চায়েতের প্রধান কংগ্রেসের সরিফুল ইসলামকে দূরের একটি দোকানে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেন মহিলারা। আর তার পরেই লছিমনে চড়িয়ে তাঁকে বিডিও অফিসে নিয়ে যাওয়া হয়।।
এই আন্দোলনে কাজ না হলে, আবারও তাঁরা পথে নামবেন বলে হুমকি দিয়েছেন গ্রামের মহিলারা।