বৌ-মেয়েকে কুপিয়ে নির্বিকার

ভরদুপুরে রোদে-গরমে কাহিল হয়ে ঝিমোচ্ছিল গোটা পাড়া। সোমবার ঠিক তখনই স্বর্ণকার বাড়ি থেকে ছিটকে এসেছিল—‘ওগো, তাড়াতাড়ি এসো। সব্বাইকে শেষ করে ফেলল!’

Advertisement

নিজস্ব সংবাদদাতা

করিমপুর শেষ আপডেট: ২৬ এপ্রিল ২০১৬ ০৩:১৪
Share:

এই ঘরেই কুপিয়ে খুন করা হয়েছে মা-মেয়েকে। ইনেসেটে, দীনেশ স্বর্ণকার।

ভরদুপুরে রোদে-গরমে কাহিল হয়ে ঝিমোচ্ছিল গোটা পাড়া। সোমবার ঠিক তখনই স্বর্ণকার বাড়ি থেকে ছিটকে এসেছিল—‘ওগো, তাড়াতাড়ি এসো। সব্বাইকে শেষ করে ফেলল!’

Advertisement

মুহূর্তের মধ্যে হইচই পড়ে যায় করিমপুরের নাটনা পশ্চিমপাড়ায়। এলাকার বাসিন্দারা স্বর্ণকার বাড়িতে ছুটে গিয়ে দেখেন, ঘরের মেঝেতে পড়ে রয়েছে স্ত্রী বীথিকার (৩৩) নিথর দেহ। পাশের খাটের উপরে ছটফট করছে মেয়ে দীপিকা (৫)। রক্তে ভেসে যাচ্ছে ঘরের মেঝে, খাটের বিছানা। অথচ সে দিকে কোনও হুঁশ নেই। নির্বিকার ভাবে বিছানায় বসে পা দোলাচ্ছে দীনেশ স্বর্ণকার।

সঙ্গে সঙ্গে মা ও মেয়ে দু’জনকেই নিয়ে যাওয়া হয় করিমপুর গ্রামীণ হাসপাতালে। কিন্তু কাউকেই বাঁচানো যায়নি। পড়শিদের দাবি, তাঁদের দেখতে পেয়েই দীনেশ শাবলের আঘাতে নিজের মাথা ফাটায়। তাকেও প্রথমে করিমপুর ও পরে শক্তিনগর জেলা হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়েছে। ঘটনার পরে বীথিকার বাবা গোরাচাঁদ কর্মকারের অভিযোগ, ‘‘দীনেশ হাঁসুয়া দিয়ে আমার মেয়ে ও নাতনিকে খুন করেছে।’’

Advertisement

নদিয়ার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (গ্রামীণ) তন্ময় সরকার বলেন, ‘‘দীনেশের বিরুদ্ধে খুনের মামলা রুজু করা হয়েছে। তবে সে গুরুতর
জখম হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। সুস্থ হলেই তাকে গ্রেফতার করা হবে।’’ প্রাথমিক তদন্তের পরে পুলিশের দাবি, ধারাল হাঁসুয়া দিয়ে স্ত্রী ও কন্যার শ্বাসনালি কেটে খুন করেছে দীনেশ। তবে তার ওই নির্বিকার
ভাবে বসে থাকাটা খুব অবাক করার মতো। জেলা পুলিশের এক আধিকারিক বলছেন, ‘‘এখনও পর্যন্ত খুনের কারণ স্পষ্ট নয়। অভিযুক্ত ওই ব্যক্তি একটু সুস্থ হলেই তাঁকে পুলিশ হেফাজতে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে।’’

প্রতিবেশীদের সঙ্গে কথা বলছে পুলিশ। — কল্লোল প্রামাণিক

তবে পরিবারের দাবি, মাঝেমধ্যেই স্বর্ণকার দম্পতির মধ্যে অশান্তি চলত। আবার তা মিটেও যেত। রবিবার রাতেও সেই অশান্তি চরমে ওঠে। গভীর রাত পর্যন্ত দু’জনের কথা কাটাকাটি শুনতে পেয়েছিলেন পড়শিরাও। তবে তার পরিণতি যে এমন ভয়ঙ্কর হতে পারে তা ভাবতে পারেননি কেউই। বীথিকার বাবা গোরাঁচাদবাবু বলছেন, ‘‘স্ত্রী ও ফুটফুটে মেয়েকে খুন করতে ওর একবারও হাত কাঁপল না! ভাগ্যিস দাদুভাই (দীনেশের ছেলে) সেই সময়ে বাড়িতে ছিল না। নাহলে ওকেও হয়তো শেষ করে দিত।’’

পুলিশ ও স্থানীয় সূত্রে জানা গিয়েছে, গত রাতে দু’জনের মধ্যে ঝগড়া হলেও সকলেই ভেবেছিলেন তা বোধহয় মিটেও গিয়েছে। বীথিকার কথাবার্তাতেও কারও তেমন সন্দেহ হয়নি। রোজ দিনের মতোই তিনি সাতসকালে উনুনে হাড়ি বসিয়েছিলেন। সকালের খাবারও খেয়েছিলেন বাড়ির সবাই। খেয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিলেন বীথিকা ও দীনেশ দু’জনেই। মেয়ে দীপিকা কিন্তু ঘুমোয়নি। সে বাবা মাকে ঘুমোতে দেখে চলে গিয়েছিল পাশের কাকুদের বাড়িতে। পরিবারের অন্যান্য সদস্যরা ভেবেছিলেন, রবিবার অনেক রাত পর্যন্ত জেগেছিল। তাই তাড়াতাড়ি খাওয়াদাওয়া সেরে হয়তো ঘুমোচ্ছে।

ইতিমধ্যে পাশের কাকুদের বাড়ি থেকে একটি মিষ্টি খেতে খেতে নিজেদের ঘরের দিকে চলে এসেছিল দীপিকা। তার কাকিমা সুপ্রিয়াদেবী বলছেন, ‘‘দীপিকা ঘরে চলে যাওয়ার পরেও ও ঘর থেকে কোনও শব্দ না পেয়ে কেমন সন্দেহ হয়। তারপর ও ঘরের দিকে পা বাড়াতেই দেখি রক্তে চারিদিক ভেসে যাচ্ছে। ভয়ে বাইরে বেরিয়ে এসে লোকজন ডাকি।’’ পুলিশের অনুমান, বীথিকাদেবী ঘুমিয়ে পড়লেও দীনেশ ঘুমোয়নি। পরে ঘুমন্ত অবস্থায় সে স্ত্রীকে খুন করে। তারপরে মেয়ে ঘরে ঢোকার পরে তাকেও সে রেয়াত করেনি। তবে পুলিশ ঘর থেকে এ দিন একটি দা ও শাবল উদ্ধার করলেও ধারাল সেই অস্ত্রের কোনও খোঁজ পায়নি।

দীনেশ পেশায় পানচাষি। বাড়িতে একটি মুদির দোকানও রয়েছে। স্ত্রী ও দুই ছেলেমেয়ে নিয়ে দীনেশ থাকত একটি ঘরে। পাশের আরও দু’টি ঘরে থাকত তাঁর আরও দুই ভাই। দীনেশের ছেলে এ বার মাধ্যমিক পরীক্ষা দিয়েছে। মেয়ে স্থানীয় প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রথম শ্রেণির ছাত্রী ছিল। এলাকায় দীনেশ ভাল ছেলেই বলে পরিচিত। পড়শিরা বলছেন, ‘‘ছেলেটা বড় মুখচোরা স্বভাবের। কিন্তু কাউকে কোনওদিন অসম্মান করত না। সেই ছেলেটাই কী ভাবে এমন কাণ্ড করে বসল বুঝতে পারছি না।’’

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement