অনুব্রত মণ্ডল গুড়-জল পাঠাননি।
শুধু জল।
অনুব্রতর জেলা বীরভূম থেকে ধেয়ে আসা একটি নদীর জলে ফি বছর বর্ষায় বানভাসি হয় বড়ঞা।
গোটা কান্দি মহকুমাই।
গ্রীষ্মে আবার সেই নদীই শুকিয়ে কাঠ। গোটা কান্দি মহকুমা জুড়ে জলের জন্য হাহাকার।
নদীর নাম ময়ূরাক্ষী। তারই দু’পাশ জুড়ে ছড়ানো বড়ঞা কেন্দ্র।
দেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকে কান্দি মাস্টার প্ল্যানের দাবিতে তোলপাড় এ তল্লাটের রাজনীতি। প্রতিটি ভোটের সময়ে সেই মাস্টার প্ল্যানের রাজনৈতিক চর্চা চলে। এ বারও তা-ই। এতটাই তার জোর যে, সোমবার ভোট প্রচারে গিয়ে কান্দির মোহনবাগান মাঠের সমাবেশ থেকে মাস্টার প্ল্যানের কথা টেনে এনেছেন খোদ রাহুল গাঁধীও।
জল থাক আর না-ই থাক, বড়ঞা কিন্তু দীর্ঘদিন লালের ছিল। ১৯৭৭ সাল থেকে ২০০৬ পর্যন্ত টানা আরএসপির দখলে ছিল এই কেন্দ্র। ২০০৬ সালে ৬১৬ ভোটে আরএসপি-র প্রার্থী বিনয় সরকারকে পরাজিত করে কংগ্রেসের প্রতিমা রজক বিধায়ক হন।
এ বারও সেই লড়াই জারি আছে। কেননা এই কেন্দ্রে বাম-কংগ্রেস জোট হয়নি। তৃণমূলের ষষ্ঠীচরণ মাল ছাড়াও প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন কংগ্রেসের প্রতিমা রজক ও আরএসপি-র বিনয় সরকার। এই অবস্থায় কান্দি মাস্টার প্ল্যানের মতো মোক্ষম অস্ত্রে কংগ্রেস একই সঙ্গে দুই প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করতে চাইছে। যে কারণে সভামঞ্চ থেকে রাহুল তোপ দেগেছেন, ‘‘ইউপিএ সরকার কান্দি মাস্টার প্ল্যান অনুমোদন করে ২৪০ কোটি টাকা বরাদ্দ করেছে পাঁচ বছর আগেই। তবুও মমতাজির সরকার সেই কাজ শেষ করেনি।’’
আরএসপি-র বিনয় সরকার আবার বড়ঞার উন্নয়ন নিয়ে বিদায়ী বিধায়ক প্রতিমা রজককে বিঁধছেন। সদ্য ষাট পেরনো বিনয় প্রশ্ন তুলছেন, ‘‘এলাকার জন্য কি কাজ করেছেন উনি?’’ প্রতিমার হয়ে ব্যাট করছেন বড়ঞা পঞ্চায়েত সমিতির বিরোধী দলনেতা, কংগ্রেসের আনারুল হোসেন— ‘‘পাঁচ বছরের হিসাব চাওয়ার আগে ১৯৭৭ থেকে ২০০৬ পর্যন্ত টানা ২৯ বছরের হিসাব আগে দিতে হবে আরএসপি-কে। টানা ২৯ বছর বিধায়কই নন কেবল, দেবব্রত বন্দ্যোপাধ্যায় আর তাঁর পরে অমল রায় দু’জনে দু’দশক ধরে সেচমন্ত্রী ছিলেন। তা সত্ত্বেও কান্দি মাস্টার প্ল্যান করেননি কেন? তার জবাব কে দেবে?’’
বিনয়বাবুর প্রায় অর্ধেক বয়সী প্রতিমা বলছেন, ‘‘জন্ম থেকে কান্দি মাস্টার প্ল্যানের কথা শুনে আসছি। প্ল্যান হবে কী করে? বছরের পর বছর ফাঁকা আওয়াজ দিয়েছেন আরএসপি-র দুই সেচমন্ত্রী। কিন্তু অনুমোদনের জন্য প্ল্যান কেন্দ্রের কাছে পাঠাননি।’’
২০১১ সালে পরিবর্তনের পরে জোট সরকারের প্রথম সেচমন্ত্রী হন কংগ্রেসের মানস ভুঁইয়া। প্রতিমার দাবি, ‘‘অধীরদার (অধীর চৌধুরী) তাগাদায় ইউপিএ সরকারের কাছে কান্দি মাস্টার প্ল্যান পাঠিয়েছিলেন মানস ভুঁইয়া। কেন্দ্র সেই প্রকল্প অনুমোদন করে ২৪০ কোটি টাকা বরাদ্দ করে। রাজনৈতিক প্রতিহিংসা চরিতার্থ করতে সেই টাকা তিন বছর ধরে ফেলে রেখেছিল রাজ্য সরকার। এখন বাধ্য হয়ে সবে কাজ শুরু করেছে।’’
দু’কাঠার জমির উপরে মাটির দেওয়ালের কাঁচা বাড়ি আর দু’টি দুধেল গাই— লক্ষ্মী আর সরস্বতী। তৃণমূল প্রার্থী, ৬৬ বছরের ষষ্ঠীচরণ মালের সম্পত্তি বলতে এই। বীরভূমের সীমানা ঘেঁষা বড়ঞায় তৃণমূলের পর্যবেক্ষক অনুব্রতর অভয়ে বলীয়ান ষষ্ঠীচরণও প্রায় মাছি তাড়ানোর ভঙ্গিতে বলছেন, ‘‘প্রতিমা কাজ করেছে কোথায়?’’ শুনে প্রতিমা ফোঁস করে ওঠেন, ‘‘মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের রাজনৈতিক প্রতিহিংসা চরিতার্থ করতে তাঁর প্রশাসন আমার বিধায়ক তহবিলের প্রায় পৌনে এক কোটি টাকার কাজ আটকে দিয়েছিল। বাধ্য হয়ে আমায় হাইকোর্টে যেতে হয়। হাইকোর্টের আদেশে সম্প্রতি কাজ শুরু হয়েছে। এর পরেও কোন মুখে তৃণমূল উন্নয়নের কথা তোলে?’’
পাল্লা কার দিকে ভারী?
পাটিগণিত বলছে, ২০১১ সালে তৃণমূল-কংগ্রেসের জোটপ্রার্থী প্রতিমা জিতেছিলেন কান ঘেঁষে। সেই হিসাবে মারাত্মক পরিবর্তন ঘটে যায় ২০১৪ সালের লোকসভা ভোটে। ২০১৪-য় আরএসপি প্রায় তলিয়ে গিয়েছে। ভোট ভাঙিয়ে তৃণমূল মাথা তুললেও কংগ্রেস শক্তি বাড়িয়েছে। এ বার উঁচুতলায় বাম ঐক্য মেনে থাকলেও হলেও সিপিএমের নিচুতলা নাকি কার যেন ‘হাত’ ধরেছে।
বড়ঞা তবে কার হাতে যেতে পারে?