ফাইল চিত্র
একটা সময় বিঘের পর বিঘে চাষের জমি, বাগান, পুকুর, দালানবাড়িতে ধানের গোলা— সবই ছিল তাঁদের বাড়ি ঘিরে। কিন্তু পদ্মার ভাঙন সবকিছু ধুয়ে মুছে নিয়ে যাওয়ার পরে এখন সে সব পলকা স্মৃতির মতো ভেসে ওঠে। সে সব বছর ষোলো আগের কথা। আর এতেই জলঙ্গির টলটলি এলাকার মণ্ডল পরিবারকে বসতে হয়েছে প্রায় পথে। প্রথম দিকে, পরিবারের সম্মানের কথা ভেবে পরিবারের কেউ যেতে চাননি ভিন রাজ্যে, কিন্তু শেষ পর্যন্ত উপায় ছিল না আর। বছর চারেক আগে মণ্ডল পরিবারের ছেলে সমিরুল ইসলাম পাড়ি দিয়েছিলেন কেরলে। সেখান থেকে পাঠানো অর্থে দু’বেলা-দু’মুঠো খাবার জুটছিল গোটা পরিবারের। কেরলের সৌজন্যে আবার একটু একটু করে সোজা হয়ে দাঁড়ানোর স্বপ্ন দেখছিল আস্ত পরিবারটি। কিন্তু প্রায় হড়কা বানের মতো করোনা তাঁদের জীবনে নিয়ে এসেছে আবারও এক নতুন ভাঙন। এক সময় পদ্মা ভেঙে দিয়েছিল যাবতীয় গৃহস্থালি, আর এ বার করোনার জেরে লকডাউন দুমড়ে মুছড়ে দিল তাঁদের মন। লকডাউন ভেঙে চোখের কোণে জল মুছতে মুছতে সমিরুল বলছিলেন, ‘‘আমাদের কী আর এ জীবনে মেরুদণ্ড সোজা করে দাঁড়ানো হবে!’’ তাঁর কথায়, ‘‘ছোটবেলায় দেখেছি গোয়াল ভর্তি গরু, পুকুর ভর্তি মাছ আর বাগান ভর্তি গাছ। কোনও অভাব ছিল না আমাদের, বরং আশপাশের গোটা দশেক পরিবার নির্ভর করত আমাদের পরিবারের উপরে। আমাদের বাড়িতে কাজ করে সংসার চলত তাঁদের। এখন আমরাই অন্যের খিদমত খাটি।’’
বুক ভরা কষ্ট নিয়ে পদ্মার শাখা নদী পাড়ে দাঁড়িয়েই সমিরুল তাঁদের পুরনো দিনে ফিরে যাচ্ছিলেন। লকডাউনে কেরল থেকে ফিরে ঠিক করেছিলেন আবার নতুন করে এখানেই গড়ে তুলবেন হারানো ঘরবাড়ি। অন্তত কিছুটা দাঁড় করাবেন। কিন্তু সে গুড়ে বালি ঢেলে কাজ জোটেনি। কখনও একশো দিনের কাজ কখনও অন্য প্রকল্পে কাজের জন্য লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে শেষতক খালি হাতেই ফিরতে হয়েছে।
সামিরুল বলেন, ‘‘অনেক জড়তা নিয়ে বাইরে গিয়েছিলাম। কিন্তু আয়ের পথটা সুগম হয়েছিল। রোজ সাতশো থেকে আটশো টাকা আয় ছিল। আর এখানে যে আসা নিয়ে ফিরলাম তাতে দিনান্তে ২৬০ টাকার বেশি আয় নেই।’’ তাই সব আশা পদ্মার কোলে রেখে ফের কেরলেই ফিরতে চাইছেন সামিরুল। বলছেন, ‘‘"ভিন রাজ্যই বাঁচিয়ে রাখবে, না হলে খাব কী!’’
সামিরুলের মতো অবস্থা এলাকার আরও অনেকের। গ্রামের বাসিন্দারা বলছেন, কেউ ইচ্ছে করে ঘর ছেড়ে বাইরে যান না। কিন্তু যেতে হয়। কখনও পদ্মা আমাদের সংসার কেড়ে নেয়। কখনও অন্য কোনও বিপদ। আমরা বুকে পাথর চেপে রাখি।