By-Election

ভোট কিসের? বুথ ছাড়, সব বুঝিয়ে দিচ্ছি

আগের রাতেই দেবগ্রাম পঞ্চায়েতের বিজেপি প্রধান শিপ্রা বিশ্বাসের রাতে বাড়িতে ভাঙচুর করা হয়েছিল। যদিও হামলা হতে পারে আঁচ করে তিনি বা তাঁর পরিবারের কেউ রাতে বাড়িতে ছিলেন না।

Advertisement

সুদেব দাস

রানাঘাট শেষ আপডেট: ১১ জুলাই ২০২৪ ০৮:০৮
Share:

পূর্ব কীর্তি নগর প্রাথমিক বিদ্যালয়ের এই বুথেই ছাপ্পা ভোটের অভিযোগ ওঠে। পরিচয় পত্র ছাড়াই এই সেই নির্বাচনী এজেন্ট। ছবি:সুদেব দাস।

আগের রাত থেকেই রানাঘাট দক্ষিণ বিধানসভা কেন্দ্রের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে হিংসা-অশান্তির খবর আসছিল। বুধবার সকাল হতেই একের পর এক ফোন। কোথাও বিজেপি বুথ এজেন্টের বাড়িতে গুলি চলেছে। কোথাও বাড়িতে ঢুকে মহিলাদের মারধর করা হয়েছে। উপনির্বাচনকে কেন্দ্র করে অন্য রকম অভিজ্ঞতা যে হতে চলেছে, সকাল থেকেই কার্যত তা আন্দাজ করা গিয়েছিল।

Advertisement

আগের রাতেই দেবগ্রাম পঞ্চায়েতের বিজেপি প্রধান শিপ্রা বিশ্বাসের রাতে বাড়িতে ভাঙচুর করা হয়েছিল। যদিও হামলা হতে পারে আঁচ করে তিনি বা তাঁর পরিবারের কেউ রাতে বাড়িতে ছিলেন না। সকালে ভোট শুরুর পর থেকেই খবর আসছিল, হবিবপুর রামনগর-২, আনুলিয়া, পায়রাডাঙা, বৈদ্যপুর, দেবগ্রাম মাঝের গ্রাম ইত্যাদি এলাকায় অধিকাংশ বুথে বিজেপি ও সিপিএমের এজেন্টদের বসতে দেওয়া হয়নি।

সকাল থেকেই পূর্ণনগর, নোকারি ও মাটিকুমরায় কার্যত পুলিশের সামনেই বাইক বাহিনীকে দাপিয়ে বেড়াতে দেখা গিয়েছে। শান্তিপুরের এক যুব তৃণমূল নেতা তার নেতৃত্বে ছিলেন বলে অভিযোগ। ন’পাড়া মুসুন্ডা, তারাপুর, আনুলিয়া আবার চাপড়ার এক দাপুটে তৃণমূল নেতা বাইক বাহিনীকে নেতৃত্ব দিয়েছেন বলে খবর। জগপুরে বিজেপির অস্থায়ী নির্বাচনী শিবির গুঁড়িয়ে দেওয়ার অভিযোগ ওঠে তৃণমূলের বিরুদ্ধে। আনুলিয়ার এক প্রবীণ ভোটার বলেন, "ভোট দিতে যাচ্ছিলাম। পথেই অপরিচিত লোকজন বলে, ভোট দিতে যাওয়ার প্রয়োজন নেই। বয়স হয়েছে, বাড়ি চলে যান।"

Advertisement

দুপুর তখন পৌনে ১টা। গাংনাপুর থানাকে বাঁ দিকে রেখে গাড়ি ছুটছিল কুপার্সের দিকে। রায়নগর রেলগেট পার করতেই অচেনা নম্বর থেকে ফোন— "গত ১২ বছর ধরে নিখোঁজ এমন লোকেরও ভোট হয়েছে পূর্ব কীর্তি নগরের প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। বুথ নম্বর ১৭৮। বুথ দখল হয়ে গিয়েছে। কার হয়ে কে ছাপ্পা ভোট দেবে বা দিয়েছে তারও তালিকা হোয়াটসঅ্যাপে দিচ্ছি।"

সরু গলির মুখে গাড়ি রেখে বুথে গিয়ে দেখা গেল, সব সুনসান। কেন্দ্রীয় বাহিনীর জওয়ানদের নির্বাচন কমিশনের দেওয়া পরিচয়পত্র দেখাতেই বুথে ঢোকার অনুমতি মিলল। দরজায় উঁকি দিয়ে দেখা গেল, ভিতরে কোনও ভোটার নেই। মাঝবয়সি এক জন বেঞ্চে পায়ের উপর পা তুলে বসে। বুথের ভোটকর্মীকে হোয়াটসঅ্যাপে পাওয়া তালিকার কয়েকটি নাম ও ক্রমিক সংখ্যা বলতেই তিনি জানালেন, ওই ভোটারেরা ভোট দিয়ে গিয়েছেন।

যিনি ১২ বছর ধরে নিখোঁজ তাঁর ভোট দিল কে?

প্রশ্ন শুনেই পায়ের উপরে পা তুলে বসে থাকা লোকটি তেলে-বেগুনে জ্বলে উঠলেন। জানলা দিয়ে গুটখার পিক বাইরে ফেলে প্রশ্ন ঝাঁঝিয়ে উঠলেন, "আপনি কে? আপনাকে অত কৈফিয়ত দেওয়া যাবে না। আগে এখান থেকে বাইরে বেরোন। তার পর বাকি কথা হবে।" নিজেকে তিনি ‘সর্বভারতীয় দলের এজেন্ট’ বলে দাবি করেন যদিও কিন্তু আর কোনও দলের এজেন্টকে বুথে দেখা যায়নি। লোকটির গলায় এজেন্টের পরিচয়পত্রও ঝুলতে দেখা যায়নি। সেটা কোথায়? একটি চিরকুট উঁচিয়ে ওই ‘এজেন্ট’ দাবি করলেন, "এটাই আমাদের পরিচয়পত্র। এর বেশি কিছু আপনাকে বলা যাবে না। আপনি আগে এলাকা ছাড়ুন। না হলে ফল খারাপ হবে।" গোলমাল শুনে ততক্ষণে চার জওয়ান ভিতরে চলে এসেছেন। তাঁদের সামনেই প্রায় তেড়ে আসেন সেই স্বঘোষিত ‘এজেন্ট’ গলা চড়াতে থাকেন। সম্বোধন ‘আপনি’ থেকে নেমে আসে ‘তুই’-তে। গলার শিরা ফুলিয়ে তিনি চেঁচাতে থাকেন— "বেশি কথা বলবি না! উপনির্বাচনে ভোট দেওয়া কিসের? রাস্তায় চল, সব বুঝিয়ে দিচ্ছি।"

বুথ থেকে বেরোতেই ২৫-৩০ জন পথ আটকে দাঁড়ায়। কী ব্যাপার? কোন সংবাদমাধ্যম? জবাব দিতেই ছিটকে আসে গালিগালাজ। প্রায় মারমুখী হয়ে উঠতে থাকে লোকগুলো। এক জওয়ান কানের কাছে ফিসফিস করে বলেন, "আভি আপ বাহার মাত নিকলিয়ে।" বাধ্য হয়ে অন্য সংবাদমাধ্যমের সহকর্মীদের ফোন করতে হয়। তাঁরাও চলে আসেন ওই বুথে। এই মাতব্বরদের মাথা কে হতে পারে তা আন্দাজ করে এক তৃণমূল নেতাকে ফোন করতেই ও-প্রান্ত থেকে আশ্বাস মেলে— "আমি দেখছি।" পরের মুহূর্তেই এক মাতব্বরের ফোন বেজে ওঠে। তাকে মুখ কালো করে বলতে শোনা যায়, "হ্যাঁ দাদা, ঠিক আছে দাদা। আর হবে না।"

এর পরেই ভিড় পাতলা হয়ে যায়। দিনের শেষে রিটার্নিং অফিসার বিপ্লবকুমার রায় বলেন, "নির্বাচন অবাধ হয়েছে। কোথাও কোনও অশান্তি-হিংসার খবর পাইনি।"

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement