মোটরবাইকের মিছিল দাপিয়ে আসতে দেখে লুকোলেন বৃদ্ধ

দূর থেকে আসছিল শব্দটা। মৃদু কিন্তু স্পষ্ট। এ ক’দিনে শব্দটা পাড়ার সকলের কাছে বেশ চেনা। রাস্তায় কয়েকটা বাচ্চা খেলছিল। বাড়ির মেয়েরা দৌড়ে গিয়ে ধরে এনে বাড়িতে ঢুকিয়ে দিল। দরজায় খিল তুলে প্রায় অন্ধকার ঘরে লুকিয়ে রইল নিজেরাও।

Advertisement

নিজস্ব সংবাদদাতা

চাকদহ শেষ আপডেট: ২১ মার্চ ২০১৬ ০১:৩৭
Share:

দূর থেকে আসছিল শব্দটা। মৃদু কিন্তু স্পষ্ট। এ ক’দিনে শব্দটা পাড়ার সকলের কাছে বেশ চেনা। রাস্তায় কয়েকটা বাচ্চা খেলছিল। বাড়ির মেয়েরা দৌড়ে গিয়ে ধরে এনে বাড়িতে ঢুকিয়ে দিল। দরজায় খিল তুলে প্রায় অন্ধকার ঘরে লুকিয়ে রইল নিজেরাও। বাড়ির বয়স্কদের কেউ কেউ জানালার ফাঁকে চোখ রেখেছেন। পাড়া কাঁপিয়ে শব্দটা চলে যেতেই স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়লেন সকলে। দরজা খুলে বেরিয়ে এলেন কেউ কেউ। তাঁদের দেখাদেখি বাকিরাও।

Advertisement

সিনেমার শ্বাস রোধ করা কোনও দৃশ্য নয়। এ দৃশ্য চাকদহের সহিষপুরের। দিন কয়েক ধরে সারা গ্রামের ঘুম কেড়ে নিয়েছে ভারি মোটরাবাইকের শব্দ। কখনও ১০-১২ জনের কখনও বা ৪০-৫০ জনের মোটরবাইক বাহিনী গ্রাম ফুঁড়ে চলে যাচ্ছে এ মাথা থেকে ও মাথা। চোখের ইশারাই বুঝিয়ে দিচ্ছে, কথা না শুনলে কখন ‘দানা’ (গুলি) ছুটে এসে পাঁজরে সেঁধিয়ে যাবে টেরটিও মিলবে না।

পরিস্থিতি এমনিই যে নিজের ক্ষোভ লুকিয়ে রাখতে পারেননি বছর সত্তরের এক বৃদ্ধ। মোটরবাইক বাহিনীর দাপটের কাছে মাথা নোয়াতে হয় তাঁকেও। দূরে মোটরবাইক বাহিনীকে আসতে দেখে গ্রামের এক দোকানের পিছনে গিয়ে লুকিয়ে পড়েন। বাইক বাহিনী চলে যেতেই বেরিয়ে আসেন। সক্ষোভে বলে ওঠেন, ‘‘কেউ যাতে টুঁ শব্দটা না করতে পারে তার জন্য মোটরবাইক বাহিনী দু’বেলা গ্রামে চক্কর কেটে যাচ্ছে। রাতে তো দূর এখন দিনেও বাইরে বেরোতে ভয় লাগছে।’’

Advertisement

দিন কয়েক আগে দু’গোষ্ঠীর সংঘর্ষের জেরে গোলাগুলি ছোটে। সেই থেকে আতঙ্ক জাঁকিয়ে বসেছে গ্রামে। গ্রামবাসীদের অভিযোগ, সেই থেকে গ্রামে মোটরবাইক বাহিনীর আনাগোনা বেড়েছে। ভটভটিয়ে চলে যাওয়া মোটরবাইক বাহিনীর শব্দে এখন সারা গ্রাম ভয়ে তঠস্থ। নেহাত দরকার না থাকলে অনেকে ভয়ে বাড়ির বাড়ির বাইরে পা রাখছেন না। প্রাণ ভয়ে বাড়ি ছাড়া গ্রামের পঞ্চায়েত সদস্যা কংগ্রেসের সন্ধ্যা ঘোষ ও তাঁর পরিবার। মোবাইল ফোনে সন্ধ্যাদেবীর স্বামী খোকন ঘোষ বলেন, ‘‘বাজারে বসেছিলাম। হঠাৎ মোটরবাইক থামিয়ে একদল লোক এসে আমার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। কোনও রকমে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে পালিয়ে আসি। এর পর কোন ভরসায় বাড়িতে থাকব বলুন তো।’’

তিনি জানান, গত পঞ্চায়েত নির্বাচনে তাঁর স্ত্রী নির্বাচিত হওয়ার পর থেকে যখন তখন তাঁর পরিবারের উপর হামলা করা হয়েছে। জমির ফসল নষ্ট করে দেওয়ায় তৃণমূলের লোকজনের বিরুদ্ধে মামলা করেন। এখন সেটি তুলে নেওয়ার জন্য চাপ দেওয়া হচ্ছে।

গ্রামে গিয়ে দেখা গেল সারা গ্রাম যেন থম মেরে রয়েছে। এক বৃদ্ধার কথায়, ‘‘কী বলব বাবা, ছোট ছোট ছেলের মুখে ভাষা শুনলে কান লাল হয়ে ওঠে। তিনকাল গিয়ে এককালে এসে ঠেকল। কিন্তু এ রকম পরিস্থিতি আগে কখনও হতে দেখিনি।’’

এই পরিবেশ হল কেন?

স্থানীয় এক বাসিন্দা বলেন, ‘‘রাজনীতি, সব রাজনীতি। একদল মানুষ ঠিক করে দিতে চাইছে, কে কাকে ভোট দেবে। যাঁরা মেনে নেবেন, তাদের কোনও সমস্যা নেই। কিন্তু যাঁরা পারবেন না, প্রতিবাদ করবেন তাঁরাই ওদের শিকার হবে।’’

গ্রামে ওই আতঙ্কের পরিবেশ নিয়ে সরব বিরোধীরা। চাকদহ ব্লক কংগ্রেসের নেতা বিধুভূষণ চক্রবর্তী বলেন, ‘‘তৃণমূলের ভয়ে আমাদের দলের সদস্যা বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে রয়েছে।’’ সিপিএমের তাতলা লোকাল কমিটির সদস্য ইসলাম খাঁ বলেন, ‘‘মোটরবাইক বাহিনীর দাপটে আতঙ্কে গ্রামাবাসীরা, ব্যবসায়ীরা ভয়ে দিন কাটাচ্ছেন।’’

আতঙ্কের কথা মানতে চাইছেন না তৃণমূলের প্রার্থী রত্না ঘোষ। তিনি বলেন, ‘‘ওই একালায় আতঙ্কের কোনও বিষয় নেই। শনিবার সেখানে গিয়েছিলাম। সকলের সঙ্গে কথা বলেছি। কেউ বাড়ি ছাড়া হননি।’’ তিনি আরও বলেন, ‘‘ওখানে কোনও মোটরবাইক বাহিনী ঢুকছে না। তা আমি বরদাস্ত করব না। মানুষ শান্তিতে থাকুক। নিশ্চিন্তে তারা ভোট দিক সেটাই চাই।’’

তৃণমূলের প্রার্থী মোটরবাইক বাহিনীর কথা অস্বীকার করলেও বাপুজি বাজার ব্যবসায়ী কমিটির সম্পাদক প্রদীপ কুমার ঘোষ বলেন, ‘‘এর আগে কখনও এই পরিস্থিতি তৈরি হয়নি। মোটরবাইক বাহিনীর ভয়ে ব্যবসায়ীরা খুব ভয় পাচ্ছেন। রাত না হতে হতেই কমবেশি সকলেই তাড়াতাড়ি দোকান বন্ধ করে দিচ্ছেন।’’

পুলিশের এক কর্তা বলেন, ‘‘এলাকার পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে। তবে ওই এলাকার পঞ্চায়েত সদস্যার বাড়ি ছাড়ার খবর জানা নেই। এ ব্যাপারে কেউ অভিযোগ জানাননি।’’

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement